জয়ী প্রার্থীদের জয়ের পথে কাঁটা যাঁরা

সব্যসাচী গুপ্ত

 

প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কেই এবার প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। হ্যাটট্রিক হয়েই গিয়েছে। এখন প্রশ্ন একটাই চতুর্থবার তিনি সংসদে যাবেন কি না। তবে এই লোকসভা কেন্দ্রে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন জনহিতকর প্রকল্পগুলি প্রসূনের প্রচারে প্রধান অস্ত্র। এদিকে জোড়াফুলেও দেখা দিয়েছে কাঁটা। কারণ, দীর্ঘকাল ধরে হাওড়া পুরসভার ভোট না হওয়ায় কিছু মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। আর হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে পাঁচটি রয়েছে হাওড়া পুরসভা ও বালি পুরসভা এলাকায়। ছয় বছর ধরে পুরভোট বকেয়া থাকায় পরিষেবা নিয়ে নানা জায়গায় নানা ধরনের অভিযোগও উঠেছে। এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বালি, উত্তর হাওড়া, মধ্য হাওড়া, শিবপুর ও দক্ষিণ হাওড়া এই পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষের রায়দানই বড় ফ্যাক্টর হবে। যদিও, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বালি, হাওড়া উত্তর, হাওড়া মধ্য, শিবপুর, হাওড়া দক্ষিণ, সাঁকরাইল এবং পাঁচলায় জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। সেটাই একমাত্র তাঁদের ভরসার জায়গা।

অন্যদিকে, হাওড়া পুরসভার প্রাক্তন মেয়র বিশিষ্ট হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসক এবং ভূমিপুত্র রথীন চক্রবর্তী উপরেই ভরসা রেখেছে বিজেপি। তৃণমূলে থাকাকালীন পুর প্রধান ছিলেন রথীন। পুরনো দলের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাচ্ছেন ভোটের ময়দানে। শহরাঞ্চলগুলিতে বেআইনি নির্মাণ ও পুকুর ভরাটের মতো, বেআইনি টোটো দাপট, পুর পরিষেবা নিয়ে অসন্তোষ, একাধিক কল কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া এরকম একাধিক ইস্যুকে সামনে রেখে শাসকদলের বিরুদ্ধে চলছে প্রতিনিয়ত আক্রমণ। বিজেপির তরফে আরও একটি বিষয়কে সামনে আনা হচ্ছে হাওড়াবাসীর সামনে। ভোটের মুখে গঙ্গার নিচ দিয়ে মেট্রোর যাত্রাপথ সূচনা। নতুন এই পরিষেবার কৃতিত্ব নিয়ে ঝোল টেনে প্রচারে খামতি রাখতে চাইছে না গেরুয়া শিবির। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে এসে এই মেট্রো পথের উদ্বোধন করে গিয়েছেন। বিজেপি প্রার্থী নিজে মেট্রোর যাত্রাপথেও প্রচার করেছেন। এরপরই হাওড়ায় প্রশ্ন উঠেছে, এই কেন্দ্রের জনমত কি তাহলে গঙ্গার তলদেশেই লুকিয়ে? প্রসূনের জয়ে ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’ রথীন কত বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন এখন সেটাই দেখার

এদিকে বনগাঁতেও বিজেপির জয় মাথা চাড়া দিয়েছে আরও এক ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’। বনগাঁ লোকসভার নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন কল্যাণ সরকার। তিনি কল্যাণীর বাসিন্দা। বিজেপির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক। কল্যাণ সরকার বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুরের প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক দাবি করেন। সাংবাদিক সম্মেলন করে নির্দল প্রার্থীর দাবি, শান্তনু ঠাকুর গত পাঁচ বছরে এলাকার কোন উন্নয়ন করেননি। মানুষের আপদে-বিপদে পাশে থাকেননি। শান্তনু ঠাকুর এবার জেতার মতো জায়গায় নেই। বেশিরভাগ বিজেপি সমর্থক আমার পাশেই রয়েছেন। সে কারণে আমি এবার ভোটে দাঁড়িয়েছি। তবে, বিজেপির সঙ্গ ছাড়তে তিনি রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘বিজেপিতে ছিলাম বিজেপিতে আছি এবং বিজেপিতেই থাকবো।’ তাঁর দাবি, বনগাঁ সংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি কাজ করতেন। বর্তমান জেলা সভাপতি দেবদাস মণ্ডল সভাপতি হওয়ার পর থেকে তিনি সাধারণ কর্মী হিসেবেই দলের কাজ করছেন। মতুয়া মহাসংঘের কল্যাণী বিভাগের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, শান্তনু ঠাকুর ভেকধারী বিজেপি। দলকে ব্লাকমেইল করে মন্ত্রিত্ব নিয়েছিলেন। মতুয়াদের ভুল বুঝিয়ে তিনি টিকিট পেয়েছেন। সিএএ চালু করার পরেও মতুয়ারা ওঁনার সঙ্গে নেই বলে দাবি করেন কল্যাণ সরকার। সঙ্গে এও মনে করিয়ে দেন, ‘এতদিন হল ওঁর বাড়িতে বসে কেউ সিএএর ফর্ম ফিলাপ করেনি। কর্মীরা আমাকেই ভোট দেবে এবং আমি জয়লাভ করব।’

এদিকে শনিবার শেষ দিনের প্রচারে বার হয়েছিলেন হুগলির তৃণমূল প্রার্থী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রচারের শেষ দিনে হুডখোলা গাড়িতে জনসংযোগ করে যেন হুগলিতে গড়লেন ‘রচনা অধ্যায়’। তিনি ‘পপুলার’, ‘দিদি নং ১’। রাজনীতির আঙিনায় নবীন হলেও রিয়্যালিটি শোয়ের সঞ্চালনার সুবাদে মানুষের কথা শোনা, আপদে বিপদে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। ভোট রাজনীতিতে তাঁর জার্নি মানুষের ভালোবাসায় মোড়া ছিল। প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণার পর প্রথম দিন সিঙ্গুরে এসে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানার উন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘শিল্পের ধোঁয়া তিনি হুগলিতে দেখেছেন। সেখানে প্রচুর শিল্প হয়েছে।’ এই নিয়ে মিম হলেও রচনা স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘মিম দেখে তিনি মজা পান। সব পাবলিসিটিই প্রচার। খুব একটা এই সমস্ত কথা গায়ে মাখেন না তিনি।’ আর এটাও সত্যি, ‘ধোঁয়া ধোঁয়া’ মন্তব্যের ধোঁয়া উড়িয়েও দমানো যায়নি হুগলির তৃণমূল প্রার্থী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। হাসিমুখে সামলেছেন সব সমালোচনা।  আর গত দেড় মাস ধরে হুগলিতে কার্যত পড়ে রয়েছেন রচনা। এলাকাবাসীর বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছেন, কারও বিয়ে বাড়িতে হঠাৎ হাজির হয়ে আশীর্বাদ করে এসেছেন। কথা দিয়েছেন জীবনভর সাধারণ মানুষের পাশে থাকবেন। মানুষের থেকেও এই প্রার্থী সাড়া পেয়েছেন বিস্তর। এদিকে তাঁর এই প্রচার নিয়ে বিস্তর অভিযোগ তৃণমূলের অন্দরেই। কারণ, তিনি সময়ের অভাবে যেতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে তৃণমূল প্রার্থী মজার ছলে বলেছিলেন, ‘আমাকে দু’টুকরো করে দিলে ভালো হয়। তাহলে আমি সব জায়গায় পৌঁছাতে পারি। না হলে আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না সব জায়গায় পৌঁছানো। সকলে আশা করছে। কিন্তু, কিছু করার নেই।’ রচনার পপুলারিটি লকেটের ভোটব্য়াঙ্কে কতটাধস নামাতে পারে এখন সেটাই দেখার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 − five =