সব্যসাচী গুপ্ত
ব্যারাকপুরে তৃণমূল আর বিজেপি’র মধ্যে যেন ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা।’ অযোধ্যা থেকে ১৩ জন শিল্পী এসেছিলেন কাঁকিনাড়ায়। রামমন্দির উদ্বোধনের আগেই। আট লক্ষ প্রদীপ দিয়ে সেখানে সাজানো হয়েছিল রামের মূর্তি। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ভাটপাড়ার তৃণমূল নেতা প্রিয়াঙ্গু পাণ্ডে। সেই প্রিয়াঙ্গু পাণ্ডেকেই দেখা গেল জগদ্দলের জিলেবি ময়দানে নরেন্দ্র মোদির সমাবেশে। রবিবার কাঁকিনাড়া থেকে লোক জড়ো করে হাজির ছিলেন প্রিয়াঙ্গু পাণ্ডে। তবে তিনি এখন ‘বিজেপির সৈনিক’! কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়া, জগদ্দলের মানুষের কাছে এসব এখন আর বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। এখানে দিন আর রাতও এত তাড়াতাড়ি বদলায় না, যত তাড়াতাড়ি তৃণমূল বিজেপি’তে বদলে যায়। আর আমাদের কাছে তো ফারাকই নেই দুই দলের।
পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র রামনবমীর পরেই এই বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভায় শাসক তৃণমূল থেকে বিজেপিতে ভিড়েছে এমন তৃণমূল নেতা, পঞ্চায়েত সদস্য, প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য, কাউন্সিলর, প্রাক্তন কাউন্সিলরের সংখ্যা শতাধিক! যেমন
নরেন্দ্র মোদির সভায় হাজির থাকতে দেখা গেল তৃণমূলের ভাটপাড়া পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার সত্যেন রায়, প্রাক্তন তৃণমূলী কাউন্সিলর, সওয়ান চৌধুরি, তৃণমূল নেতা সুরজ সিং। এঁরা এখন অর্জুন সিংয়ের ‘বাহিনী’-র অংশ। নিন্দুকেরা বলছে, তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিকের বিধানসভা এলাকাতেই গত কয়েকদিনে বেমালুম তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি’তে ঢুকে রাতের অন্ধকারে সিপিআই(এম)’র যাবতীয় ফ্লেক্স, ব্যানার ছেঁড়ার দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে পলাশির তৃণমূল নেতা শিবু অধিকারী, সুমন দাস। গত সপ্তাহেই আবার মামুদপুরের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সুমিত ঘোষ, ব্যারাকপুর গ্রামীণের শিউলি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সদস্য মিঠু চট্টোপাধ্যায় নাম লিখিয়েছে পদ্ম শিবিরে। ফলে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের মানুষের কাছে গত কয়েক বছর ধরে কে তৃণমূল, কে বিজেপি এটা মনে রাখাই যেন একটা ‘শাস্তি’!
যেমন, অর্জুন সিং তৃণমূলে ছিলেন। ২০১৯-এ বিজেপি’র হয়ে সাংসদ। তারপর ২০২২-এ অভিষেকের হাত ধরে আবার তৃণমূলে। অর্জুন সিংয়ের ছেলে এখনও বিজেপি’র ভাটপাড়ার বিধায়ক। ফের ২০২৪’র তৃণমূলের ব্রিগেড সভার মঞ্চ থেকে সোজা ঢুকে পড়লেন বিজেপি’তে। গেরুয়া শিবিরের প্রার্থীই তিনি। তাঁর ভাইপো সৌরভ সিং আবার তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিকের মুখ্য নির্বাচনী এজেন্ট। ভগ্নিপতি সুনীল সিং আবার ফিরে গিয়েছেন তৃণমূলে।
আর ওদিকে মিডিয়ায় লাইভ কভারেজে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ‘গোটা রাজ্যে একমাত্র তৃণমূলই লড়ছে বিজেপি’র বিরুদ্ধে! তাই বিজেপি’কে হারাতে সিপিআই(এম)-কংগ্রেসকে নয় কেবল তৃণমূলকে ভোট দিন!’ এদিকে শুভেন্দু অধিকারী থেকে অর্জুন সিংয়ের প্রচার, ‘তৃণমূলকে হারাতে সিপিএমকে ভোট নয়।’ যাতায়াত বজায় রেখেই দু’দলের চিত্রনাট্যে অভিন্ন শত্রু কেবল লাল ঝাণ্ডাই।
এদিকে মোদির সভাস্থল থেকে খানিকটা দূরে জেজেআই চটকলের ছবিটা একটু দেখা যাক। শ্রমিকেরাই জানাচ্ছেন, গত জানুয়ারিতে নতুন ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে এখন সব মিলিয়ে মজুরি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪১ টাকা। যদিও বিসিএমইউ’র তরফে দাবি করা হয়েছিল দৈনিক আট ঘণ্টায় ১০০০ টাকা! অর্থাৎ মাসে ২৬ দিনে ২৬ হাজার টাকা। এক ধাপ এগিয়ে তৃণমূলের তরফে দাবি করা হয়েছিল ১ হাজার ৫০ টাকা দৈনিক। তাতে শ্রমিকদের মনে হয়েছিল তৃণমূল তাঁদের কথা ভাবছে। এরপর সে ভুল ভাঙে। কারণ, এই শ্রমিকেরা জানতে পারেন, ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সবার আগে তৃণমূলই বলেছে এত টাকা দরকার নেই। দৈনিক দু’শো টাকা করে দিলেই হয়ে যায়। আর বিজেপি তো চুপ। আর এখানেই মিল শ্রমিকেরা ধন্দ্বে মালিকের বড় দালাল কারা?
চটকল শ্রমিকদের অভিযোগ, শাসক তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবই শিল্পাঞ্চলের এমন দশা করেছে যে চটকল শ্রমিকের সন্তানরা এখন আর কেউ জুট মিলে কাজ করতে চায় না। এখানের অনেকেরই তিন পুরুষ এখানে লেবার লাইনে থেকে জুট মিলে কাজ করতেন। তবে এখন তাঁদের বর্তমান প্রজন্ম পাড়ি জমিয়েছেন দক্ষিণ ভারতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে। তবে সবথেকে আশ্চর্যের খবর হল, এখানে এখন নাইট শিফটে কাজে যেতে ভয় পায় শ্রমিকরা। কারণ, যাঁরা পরিবার নিয়ে থাকেনা তারা নাইট শিফটে কাজে গেলে রাতের লেবার লাইনের ঘর থেকে খাট, আলমারি, রান্নার জিনিসপত্র পর্যন্ত চুরি হয়ে যায়। লেবার লাইনে ঘর বন্ধ করে রাস্তায় যেতে পারেন না তাঁরা। থানায় চুরির অভিযোগ নিয়ে গেলে পুলিশ ফেরত পাঠিয়ে দেয়। তৃণমলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে না। জগদ্দল থানায় নাকি চুরির অভিযোগ নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে এই শ্রমিকদেরই একজন মোদির সভা ফেরত লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমরা এমন শিল্পাঞ্চলকে চিনতে পারছি না। কারখানার ভিতরে শ্রমিকদের ধর্মে ভাগ করা হচ্ছে। মিলের ভিতর এমন জাতপাত ধর্মের ভাগ তৈরি হয়ে যাবে ভাবিনি কোনোদিন। এসব কোনোদিনও ছিল না বামফ্রন্টের আমলে। বিজেপি এবং তৃণমূল একসঙ্গে এই জিগির তৈরি করছে। জাত ধর্মে সব ভাগ হয়ে যাচ্ছে!’ গঙ্গার পূর্বপাড় ধরে চটকলকে আঁকড়ে ধরেই এগোতে থাকা মলিন জনপদ, চিমনি ধোঁয়ায় হাসি ফোটা লেবার লাইনেও ঢুকিয়ে দেওয়া বিভাজনের বিষ! এই প্রসঙ্গে ব্যারাকপুর কেন্দ্রের কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্ট প্রার্থী দেবদূত ঘোষ জানান, ‘গত পনেরো বছরে তৃণমূল ও বিজেপি’র সাংসদ কেউ মানুষের কথা, শ্রমিকদের কথা সংসদে তুলে ধরেনি। বরং গোটা তল্লাটকে অশান্তির আগুনে পুড়িয়েছে যাতে হকের দাবি তুলতে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে মানুষ। দলবদলের খেলার ঘৃণ্য চেহারা দেখেছে রোজ বারাকপুর।’ এর পাশাপাশি সিপিআই(এম) নেত্রী গার্গী চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘শিল্পাঞ্চলেই এখন কাজের আকাল। আস্ত শিল্পাঞ্চলে দুষ্কৃতীরাজের রমরমা। আর সেসব ঢাকা দিতেই দু’দলই বেমালুম ধর্মীয় জিগির তৈরি করছে। বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতেই লাল ঝাণ্ডার জয় প্রয়োজন। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।’