জয় এলেও শাসকদলকে চিন্তায় রাখল শহরাঞ্চলের ভোটাররা

কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি এর দখলে দুটি বিধানসভা, অন্তত এমনটাই বোঝা যাচ্ছে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল সামনে আসার পর। ৭ টি বিধানসভার মধ্য দুটি বিধানসভা বিজেপির দখলে, ৫ টিতে তৃণমূল। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, জোড়াসাঁকো ও শ্যামপুকুর দুটো বিধানসভা বিজেপির দখলে।

নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, খুব কম ব্যবধানে হলেও বিজেপির দখলে গেছে দুটো আসন। জোড়াসাঁকো আসনে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৪১৮৯৩ টি ভোট, বিজেপি পেয়েছে ৪৯২৯৪ টি ভোট, আবার শ্যামপুকুর আসনে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৪৮০৬৩ টি ভোট, বিজেপি পেয়েছে ৪৯৬৬২ টি ভোট।

উত্তরবঙ্গের গুটিকয়েক আসন বাদ দিলে দক্ষিণে কার্যত নিরঙ্কুশ জয় ঘরে তুলেছে তৃণমূল। নির্বাচনে বিপুল সাফল্য এলেও শহরাঞ্চলের ভোটাররা শাসকদল তৃণমূলকে চিন্তায় রাখল। পুরসভার ফলে পাহাড় থেকে সমতল- সর্বত্রই এক ছবি। নিজেদের দখলে থাকা পুরসভায় পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি পুরপ্রধান, উপ-পুরপ্রধান থেকে শুরু করে ধরাশায়ী হয়েছেন হেভিওয়েটরাও।

পর্যালোচনায় উঠে আসছে খারাপ পরিষেবা থেকে শুরু করে দুর্নীতি এমনকী, তোলাবাজির অভিযোগও। দলের নেতৃত্ব অবশ্য মানছেন, খামতি কোথাও একটা রয়েছে। আপাতত সেই খামতি পূরণই তাঁদের কাছে প্রধান কাজ। উত্তর এবং দক্ষিণ- কলকাতার দু’টি আসনের পাশাপাশি বড় ব্যবধানে জয় এসেছে যাদবপুর কেন্দ্রেও। তার মধ্যেও শাসক দলকে চিন্তায় রাখছে ওয়ার্ড ভিত্তিক ফলাফল। সেখানে বেশ কিছু আসনেই পিছিয়ে রয়েছেন শাসক দলের কাউন্সিলাররা।

শাসক দলের কপালে ভাঁজ ফেলেছে ওয়ার্ড ভিত্তিক ফলাফল। সেখানে বেশ কিছু আসনেই পিছিয়ে রয়েছেন শাসক দলের কাউন্সিলাররা। এঁদের কেউ কেউ বিধায়ক, মায় মন্ত্রীও। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩২টিতেই এগিয়ে ছিলেন ঘাসফুলের প্রার্থীরা। তথ্য অনুযায়ী, এবারে ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৯টি ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল। এর মধ্যে ৪৫ জনই শাসক দলের কাউন্সিলার। রয়েছেন পাঁচ মেয়র পারিষদ সদস্যও। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও তৃণমূল ৫১টি ওয়ার্ডে বিজেপির তুলনায় কম ভোট পেয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু সেন বলেন, ‘বিধানসভা-লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপট আলাদা। পুর ভোটে এই ফল থাকবে না। তবে কেন এমন হলো তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।’ দক্ষিণ কলকাতার ৮৪ টি ওয়ার্ডের মধ্যে এবারে ২১টিতে পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে এরমধ্যে ৮১টি ওয়ার্ড দখলে রেখেছিল তারা। তবে স্বস্তির খবর একটাই, এখানে সবকটি বিধানসভাতেই শাসক দল এগিয়ে রয়েছে। কলকাতা উত্তরের ৬০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টি ওয়ার্ডে জোড়াফুল শিবির পিছিয়ে পড়েছে। পাশাপাশি শ্যামপুকুর এবং জোড়াসাঁকো বিধানসভাতেও এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, পরিষেবা একটা বড় কারণ। পানীয় জলের পাশাপাশি জঞ্জাল অপসারণ নিয়ে বেশ কিছু ওয়ার্ডে অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় জল জমার অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি মেয়র ফিরহাদ হাকিমের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এক কাউন্সিলার। এর পাশাপাশি শহর কলকাতায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, দুর্নীতি। সাম্প্রতিক কালে শিক্ষা থেকে রেশন, দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে বিতর্কের পাশাপাশি বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্ধার শহুরে ভোটারদের তৃণমূল-বিমুখ করেছে।

কলকাতার পাশাপাশি শহরতলিতেও খারাপ ফল চিন্তায় রেখেছে শাসক দলকে। বারাসত লোকসভার চারটি পুরসভাতেই তৃণমূলের ফল শোচনীয়। বারাসত পুরসভার ৩৫ টি ওয়ার্ডের মধ্যে শাসক দল এগিয়ে মাত্র ৬টি ওয়ার্ডে। অশোকনগর পুরসভাতেও ২৩ টির মধ্যে মাত্র ৬টি ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী, জেলবন্দি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কেন্দ্র হাবড়া পুরসভায় সবকটি কেন্দ্রেই পিছিয়ে তৃণমূল। একমাত্র মধ্যমগ্রাম পুরসভার ২৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টিতে বিজেপির থেকে এগিয়ে রয়েছে জোড়াফুল।

বনগাঁ পুরসভায় ২২টির সবকটিতেই ভরাডুবি হয়েছে তৃণমূলের। এখানকার প্রাক্তন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যও রেশন দুর্নীতিতে জেল বন্দি। এখানে এটাই ভরাডুবির মূল কারণ বলে ধারণা শাসক দলের নেতাদের। গোবরডাঙ্গা পুরসভার ১৭ টির মধ্যে ১৫টিতেই পিছিয়ে তৃণমূল। দুর্নীতির পাশাপাশি পুর পরিষেবাও এর পিছনে বড় কারণ বলে মনে করছে শাসক দল। পূর্ব বর্ধমান কেন্দ্রে ১ লক্ষ ৬০ হাজারেরও বেশি ভোটে তৃণমূল প্রার্থী শর্মিলা সরকার জয়ী হলেও সেখানে কাঁটা হয়ে রয়েছে এই কেন্দ্রের তিনটি পুর এলাকার ফল।

এদিকে কাটোয়া, কালনা এবং দাঁইহাট তিনটি পুর এলাকাতেই পিছিয়ে থেকেছেন শর্মিলা। এক্ষেত্রে সংগঠনিক দুর্বলতার মতো বিষয়ের সঙ্গে উঠে এসেছে পুর পরিষেবা নিয়ে নাগরিকদের অসন্তোষ। এরই পাশাপাশি জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম হোক বা উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্র। সর্বত্র ভরাডুবি হয়েছে তৃণমূলের। এখানে পিছিয়ে পড়ার কারণ, পরিষেবা নিয়ে বাসিন্দাদের অসন্তোষ বলেও মত বাসিন্দাদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − eleven =