ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস

ফিরল করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার স্মৃতি। সোমবার সকালে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখে শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সোমবার সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে শিয়ালদহের দিকে রওনা দিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। ফাঁসিদেওয়ার রাঙাপানি স্টেশনের কাছে সকাল ৮টা ৫০ মিনিট নাগাদ আচমকা ওই ট্রেনে পিছন দিক থেকে একটি মালগাড়ি এসে ধাক্কা মারে। তারই প্রতিঘাতে লাইনচ্যুত হয় দুটি কামরা। একটি কামরা দুমড়ে মুচড়ে উল্টে যায়। আরেকটি কামরা উঠে যায় ইঞ্জিনের উপরে।

প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে, শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন সবেমাত্র ছেড়ে কিছুটা দূরে এগিয়েছিল। রাঙাপানি এলাকায় ট্রেন পৌঁছতেই উল্টোদিক থেকে চলে আসে একটি মালগাড়ি। মালগাড়ির ধাক্কায় ছিটকে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুটো বগি। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় বাসিন্দারাই উদ্ধারকাজ শুরু করেন। এরপর ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এবং রেল দফতরের কর্মীরা।

এদিকে এদিনের দুর্ঘটনায় যে কামরাটি দুমড়ে গিয়েছে, সেটি অসংরক্ষিত কামরা বলেই জানানো হয়েছে রলে দফতরের তরফ থেকে। আর সেই কারণেই সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তায় রেলের আধিকারিকরা। যেহেতু অসংরক্ষিত, তাই প্রচুর মানুষের ভিড় ছিল তাতে। ফলে সেখান থেকে উদ্ধার করা খুবই জটিল হয়ে পড়ে। গ্যাস কাটার দিয়ে বগি না কাটলে উদ্ধার করা সম্ভব নয় বলেও জানান রেল কর্মীরা। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বগিটির ভিতর থেকে আসতে থাকে গোঙানির শব্দ। তবে এরই মাঝে তৎপরতার সঙ্গে উদ্ধারকার্য চালান রেলকর্মীরা।

এদিকে যাঁরা আহত তাঁদের অ্যাম্বুল্যান্সে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হয়। যেহেতু প্রত্যন্ত এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই সেখান থেকে হাসপাতাল অনেকটা দূর। তাই আগে উদ্ধার করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হয়।

কী ভাবে ঘটনাটি ঘটল, তা এখন তদন্ত সাপেক্ষ। তবে প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে, সিগন্যালিংয়ের সমস্যার কারণেই একই লাইনে চলে এসেছিল মালগাড়িটি। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। মালগাড়িটি কোন জায়গায় এসে গতি বাড়ায়, কিংবা কোথায় সিগন্যাল ছিল, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সিগন্যাল ফেল করেছিল কিনা, সবটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এদিকে সূত্রে খবর, রেলওয়ের তরফে নির্দেশ থাকে, উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতাগামী যে ট্রেনগুলি থাকে, সেগুলিকেই মূলত গুরুত্ব দিয়ে প্রথমে লাইন দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সেই লাইনে দেওয়া হয় অন্যান্য ট্রেন। আজকের দুর্ঘটনার পর প্রথম প্রশ্ন উঠছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা যাওয়ার সময় কীভাবে মালগাড়ি চলে এল? কীভাবে ওই ক্রসিং পয়েন্টে এসে মালগাড়ি ধাক্কা মারল, সেই প্রশ্নও উঠেছে। জানা গিয়েছে, মালগাড়িটি ওভারলোডেড ছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গতি ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার ছিল। মালগাড়িটিও যথেষ্ট গতি ছিল। এই দুর্ঘটনার পিছনে অন্তর্ঘাত রয়েছে কি না, সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের সংযোগকারী রুট এটি। এই দুর্ঘটনার পর আপাতত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে বন্ধ হয় ট্রেন চলাচল।

এদিনের কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ফের একগুচ্ছ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যাত্রী সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে রেলের তরফে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে আগেই। সেই হাইটেক প্রযুক্তির তালিকায় রয়েছে ট্রেনের সংঘর্ষ এড়ানোর ‘কবচ’ সিস্টেমও। কবচ সিস্টেম হল একটি অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম। যা ট্রেনের সংঘর্ষের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য করে দেয়। যদি ট্রেনের লোকো পাইলট সময়ের মধ্যে ব্রেক কষতে ব্যর্থ হন, তাহলে এই কবচ সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেনের গতি কমিয়ে আনে। এই হাইটেক প্রযুক্তিতে ব্যবহার হয় আরএফআইডি (রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) ট্যাগ, যেগুলি বসানো হয় রেলের ট্র্যাকে, স্টেশন ইয়ার্ডে ও সিগনালে। এই সিস্টেম অ্যাক্টিভেট হয়ে গেলে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা বাকি সব ট্রেন থামিয়ে দেয় এবং সংশ্লিষ্ট ট্রেনটি নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ‘কবচ’ এখনও বসে ওঠেনি সব লাইনে। বাংলার কোনও ট্র্যাকেই এখনও বসেনি কবচ প্রযুক্তি। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর এমনটাই জানিয়েছে রেল বোর্ড। বাংলার ক্ষেত্রে কবচ প্রযুক্তি এখনও পরিকল্পনার আওতাতেই রয়েছে। দেশে এখনও পর্যন্ত মাত্র দেড় হাজার কিলোমিটার রেল ট্র্যাকেই বসেছে কবচ সিস্টেম। এক্ষেত্রেও যদি রেলের ট্র্যাকে কবচ সিস্টেম থাকত, তাহলে কি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সঙ্গে মালগাড়ির এই ভয়াবহ সংঘর্ষ এড়ানো যেত কি না তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এদিকে রেল বোর্ডের তরফে জানানো হয়েছে, ‘এই কবচ সিস্টেম ধাপে ধাপে কার্যকর করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই দেশে দেড় হাজার কিলোমিটার রেলপথে কবচ রয়েছে। এই বছর আরও তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথে কবচ বসে যাবে। এই বছর যে তিন হাজার কিলোমিটার পথে কবচ বসবে, সেই তালিকায় বাংলাও রয়েছে। দিল্লি-হাওড়া রুটে কবচ সিস্টেম বসবে।’

এরপর ১২টা ৪০ মিনিটে ট্রেনের অক্ষত অংশ নিয়ে রওনা দেয় শিয়ালদহের উদ্দেশ্য়ে রওনা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। দুর্ঘটনাগ্রস্ত চারটি বগি বাদ রেখে ১ হাজার ২৯৩ জন যাত্রীকে নিয়ে রওনা দেয় বাকি এক্সপ্রেসটি।

এদিকে পূর্ব রেল সূত্রে খবর, দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড। ফলে  নতুন গার্ড নিয়ে চলতে শুরু করে ট্রেন। যাঁরা ট্রেনে রয়েছেন তাঁদের খাবারের বন্দোবস্তও করা হয়েছে রেলের তরফে। আলুয়াবাড়ি স্টেশনে যাত্রীদের সকলকে জল ও খাবার দেওয়া হয়। আপাতত যা জানা যাচ্ছে তাতে রাত ১টা বেজে ০৪ মিনিটে পৌঁছনোর কথা শিয়ালদহে। অপরদিকে, হেল্পডেস্কও চালু করা হয়েছে রেলের পক্ষ থেকে। হেল্পলাইন নম্বর প্রকাশ করা হয়েছে। কোনও রকম সমস্যায় পড়লে ওই নম্বরগুলিতে ফোন পারবেন যাত্রীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 3 =