রাজ্য় পুলিশের এসটিএফ-এর হাতে ধৃত নয়া জঙ্গি গোষ্ঠীর মাথা

পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসা থেকে জঙ্গি যোগ সন্দেহে রাজ্য পুলিশের স্পেশ্য়াল টাস্ক ফোর্সের জালে মহম্মদ হাবিবুল্লাহ। রাজ্য পুলিশের এসটিএফ সূত্রে খবর, শনিবার কাঁকসা থানা থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে মীরপাড়া এলাকায় অভিযান চালানো হয়। সেখানেই এই মহম্মদ হবিবুল্লা নামে এক কলেজ ছাত্রকে আটক করা হয়। কাঁকসা থানায় দীর্ঘক্ষণ জেরার পর তাকে গ্রেফতার করে এসটিএফ। সূত্রে খবর, ধৃত মহম্মদ হাবিবুল্লাহকে ১৪ দিনের এসটিএফ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

এদিকে তদন্ত যত এগোচ্ছে ততই সামনে আসছে নতুন-নতুন তথ্য। সূত্রের দাবি, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার-উল-ইসলামের সদস্য ছিল হবিবুল্লা। সেই সংগঠনের অন্যতম ‘ফিদায়েঁ’ ইসমাইল শাহাদত। মনে করা হচ্ছে তার নামেই তৈরি হয়েছে নতুন এই মডিউল। যার অর্থ, নিজে থেকে শহিদ হওয়া। অর্থাৎ আত্মঘাতী জঙ্গি বা ‘ফিদায়েঁ’। জিহাদের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতেও পিছপা হব না, এই সংকল্পের বীজই বুনে দেওয়া হত সদস্যদের মধ্যে। সূত্রের দাবি, বিদেশে আত্মগোপন করে সালাউদ্দিন নাসের মডিউলটি অপারেট করে।

শুধু তাই নয়, ‘শাহাদাত’ নামে যে নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী গজিয়ে উঠেছে তা  বাংলাদেশেও বেশ সক্রিয়। এই গোষ্ঠীর সঙ্গেই মহম্মদ হাবিবুল্লাহর যোগ রয়েছে বলে খবর। গোয়েন্দা দফতর সূত্রে খবর, ধৃত মহম্মদ হাবিবুল্লাহই ভারতে শাহাদাত পরিচালনা করত। বলা ভাল, এ দেশে জঙ্গি মডিউলের ‘মাথা’ সেই।

রাজ্যে পুলিশ সূত্রে এ খবরও মিলেছে, জানা যাচ্ছে, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছিল বছর একুশের এই যুবক। প্রথম বর্ষের ছাত্র। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে আশি শতাংশের বেশি নম্বর নিয়ে পাশ করেছিল মহম্মদ হাবিবুল্লাহ। এদিকে এই জহ্গি গোষ্ঠী মূলত সোশাল মিডিয়ায় জাল বিছিয়ে যুবক-যুবতীদের দলে টানত তারা। প্রথমে চলত স্ক্যানিং। দেখা হত, কারা ইসলামিক মৌলবাদের প্রতি আগ্রহী। তারপর অডিও মেসেজ পাঠিয়ে চলত মগজ ধোলাই। একইভাবেই ‘রিক্রুট’ করা হয়েছিল হবিবুল্লাকে।এরপর এই হাবিবুল্লাহ নব্য এই মডিউল ডিজিটাল মাধ্যমের দ্বারা জাল বিস্তার করতে চেয়েছিল। ইউটিউব চ্যানেল খোলারও প্রক্রিয়াও শুরু করে। এর পাশাপাশি  আইএসআইএস-এর মতো পতাকা তৈরি করেছিল। ধৃত হাবিবুল্লাহ-র থেকে মিলেছে ল্যাপটপ ও মোবাইল। এছাড়াও তিরিশটি ই-মেল আইডির তথ্য। বাংলাদেশে এই মডিউল ‘শাহাদাত’-এর দুই সদস্য জালে পড়তেই জানা যায় নব্য এই মডিউলের সক্রিয়তা। সদস্যদের আফগানিস্তানে পাঠিয়ে তালিবানের হাতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও সামনে এসেছে।

সঙ্গে এও জানা যাচ্ছে, জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ জঙ্গি সংগঠনের প্রাক্তন শীর্ষ নেতাই এই ‘শাহাদাত’-এর প্রতিষ্ঠাতা। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর জেএমবির রাজ্যের নেটওয়ার্ক প্রকাশ্যে আসার পরেই আদর্শগত কারণে ভাঙন ধরে জেএমবি সংগঠনে। এক অংশ আইসিস মতাদর্শে এগোতে চায়। অন্য অংশ জেএমবির সংগঠনের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে যেভাবে আলকায়দা মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল সেই পথে। এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীর শীর্ষ সংগঠক সালাউদ্দিন ওরফে ‘বড় ভাই’। সালাউদ্দিন বাংলাদেশে না ফিরে ভারতেই ঘাঁটি করে। সালাউদ্দিন, আলকায়দা পন্থীদের নিয়ে ‘জামাতুল মুজাহিদিন হিন্দ’ নামে সংগঠন তৈরি করে। এই রাজ্য এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংগঠন বিস্তর লাভ করে। এদিকে জেএমবির অন্তর্দ্বন্দ্বর জেরে বাংলাদেশে আইসিস এবং আল কায়েদাপন্থী দু’দলের অনেক সদস্য ধরা পড়ে। এরপরেই, বাংলাদেশের আনসার আল ইসলামের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এগোনো শুরু সালাউদ্দিনের। বাংলাদেশে পর আনসারের কর্মী ধরপাকড়ের পর নতুন সংগঠন ‘শাহাদাত’ তৈরি হয়। ভারত থেকে সালাউদ্দিন ওই সংগঠক নিয়ন্ত্রণ করে। তিন সপ্তাহ আগে আনসার এবং নতুন সংগঠনের তিন শীর্ষ নেতা বাংলাদেশে গ্রেফতার হয়।

রাজ্য গোয়েন্দা দফতর সূত্রে আরও খবর, এরপরেই সালাউদ্দিন ভারত থেকে অডিও বার্তা দেন দলের কর্মীদের। নির্দেশ দেন অবিলম্বে বাকি সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ হওয়ার। এরপরেও দু দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে দু’জন গ্রেফতার হয়। সেই সূত্র ধরে গ্রেফতার হয়েছে মহম্মদ হাবিবুল্লাহ। আপাতত হাবিবুল্লাহকে জেরা করে দ্বিতীয় গোষ্ঠীর শীর্ষ সংগঠক সালাউদ্দিন ওরফে ‘বড় ভাই -এর হদিশ করছেন গোয়েন্দারা।

একই সঙ্গে রাজ্য পুলিশের এসটিএফ-এর তরফ থেকে এও জানানো হয়েছে, এই জঙ্গি ‘বিপ’ নামে একটি গোপন রহস্যময় মেসেজিং প্লাটফর্মের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতো। তবে এরই মাঝে গোপন সূত্র মারফত খবর পেয়ে শনিবার পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসায় অভিযান চালান রাজ্যের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের অফিসাররা। সেই অভিযানেই কাঁকসার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় মহম্মদ হাবিদুল্লাকে।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা শ্রেয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি বাংলাদেশের একটি জঙ্গি সংগঠন। এই সংগঠনটি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি নাস্তিক ব্লগারদের খুনে জড়িত।  ২০১৫ সালের মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ সরকার। এরপর থেকে আল কায়েদা দলটির সদস্যরাই আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা চালিয়ে আসছে।পশ্চিমবঙ্গ, অসম সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট বাংলাদেশের আনসার আল ইসলাম জঙ্গিরা তাদের সংগঠনের পুরনো নাম ‘এবিটি’ ভারতের মাটিতে ব্যবহার করে। দুই রাজ্যেই সংগঠনটির বেশকিছু সদস্য পুলিশের জালে। তবে বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যকলাপ আপাত স্থিমিত বলেই দেশটির গোয়েন্দা বিভাগ একাধিকবার রিপোর্ট দিয়েছে। ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশান এলাকায় হামলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদশে ঘাঁটি তৈরি করা জঙ্গি বিরোধী জিরো টলারেন্স নীতিতে আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট ঘনিষ্ঠ জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়। তবে সেই রিপোর্টে বলা হয়,সরাসরি হামলা ও নাশরতার বদলে মগজ ধোলাই নীতিতে জোর দিয়েছে সংগঠনগুলি। এর  পাশাপাশি বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলি ভারত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির মধ্যে নিজেদের ‘সেফ করিডর’ তৈরি করে রেখেছে। বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলির বিশেষ পছন্দ পশ্চিমবঙ্গ ও অসম। ত্রিপুরা, মেঘালয়ে আছে বাংলাদেশের সশস্ত্র পাহাড়ি উপজাতি সংগঠনগুলির যাতায়াত। এদিকে সম্প্রতি ঢাকার শাহিনবাগ, গুলিস্তান এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে নয়া ‘শাহাদত’ মডিউলের ৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সূত্রের দাবি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই বাংলার তিন চক্রীর হদিশ মিলেছে। মূলত ঢাকা, সাতক্ষীরা, যশোর এলাকা অপারেট করে তারা। বর্ধমানের ধৃতদের রবিবার আদালতে পেশ করা হয়েছে। ইউএপিএ-সহ একাধিক ধারায় দায়ের হয়েছে মামলা। ধৃতদের নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করে ষড়যন্ত্রের গভীর পৌঁছতে চাইছেন তদন্তকারীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 3 =