মমতার বিরুদ্ধে রাজ্যপালের মানহানি মামলায় সংবাদমাধ্যমকে পার্টি করার নির্দেশ আদালতের 

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। মুখ্যমন্ত্রীর করা কিছু মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আজ, বুধবার সেই মামলার শুনানি ছিল কলকাতা হাইকোর্টে। বিচারপতি কৃষ্ণা রাওয়ের বেঞ্চে শুনানি চলাকালীন রাজ্যপালের আইনজীবী ধীরজ ত্রিবেদী জানান, রাজ্যপালের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। রাজ্যপাল সম্পর্কে কী মন্তব্য করা হয়েছে, তা ভিডিয়োতেই দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী। এরপরই সব সংবাদমাধ্যমকে মামলায় যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এই মামলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও রয়েছে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের নামও। রাজ্যপালের আইনজীবী জানিয়েছেন, ‘সংবাদমাধ্যমে যা লেখা হয়েছে সেটা ওই ব্যক্তি নিজেই বলেছেন।’ এরপরই বিচারপতি রাও প্রশ্ন করেন, ‘সংবাদপত্রকে পার্টি করা হয়নি?’ এ কথা শুনে আইনজীবী পাল্টা প্রশ্ন করেন, সংবাদমাধ্যমকে পার্টি করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তা নিয়েও। এরপরই বিচারপতির নির্দেশ দেন, সব সংবাদমাধ্যমকে মামলায় যুক্ত করা হবে। কুণাল ঘোষ ছাড়া তৃণমূল দুই জয়ী প্রার্থী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রায়াত হোসেনকেও মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। আইনজীবী আর্জি জানান, এরা কেউ যাতে আগামিদিনে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে মন্তব্য না করেন। আদালত সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার এই মামলার পরবর্তী শুনানি। তবে বুধবার রাজ্যপালের দায়ের করা মানহানি মামলায় বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আইনি লড়াইয়ে লড়তে নামতে দেখা যায় দুই প্রাক্তন এজিকেও। মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে আইনজীবীদের যে প্যানেল আদালতে সওয়াল করবেন, সেই দলে ছিলেন জয়ন্ত মিত্র এবং সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। দু’জনেই রাজ্যের প্রাক্তন এজি। দু’জনেই মুখ্যমন্ত্রী মমতার আমলে এজি পদ ছেড়েছিলেন। এঁদের মধ্যে পদত্যাগের পর সরাসরি সরকারের প্রতি উষ্মাপ্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল জয়ন্তকে। সৌমেন্দ্রনাথের পদত্যাগ নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছিল বিস্তর।

মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টে মানহানির মামলা করেছিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। বুধবারই সেই মামলার শুনানি ছিল বিচারপতি কৃষ্ণা রাওয়ের এজলাসে। যদিও বুধবারের শুনানিতে তাঁরা সওয়াল করেননি। অন্যদিকে রাজ্যপালের হয়ে এই মামলা লড়ছেন কেন্দ্রের ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল ধীরাজ ত্রিবেদী। মামলার শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের বর্তমান এজি কিশোর দত্তও। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, রাজ্যের এজি পদে ছিলেন জয়ন্ত। অর্থাৎ, প্রথম মমতা সরকারের মাঝামাঝি সময় থেকে দ্বিতীয় মমতা সরকারের প্রথম দিক পর্যন্ত রাজ্যের এজি ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই সময় বিভিন্ন আইনি বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর মতের অমিল প্রকাশ্যে আসে। এর পর ২০১৭ সালে তৎকালীন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে ইস্তফাপত্র জমা দিয়ে সরকারের সঙ্গে মতের অমিলের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন জয়ন্ত। জানান, সরকারের সঙ্গে মতান্তর ক্রমে বাড়ছিল। বেশ কিছু বিষয়ে তাঁর পরামর্শও মানা হচ্ছিল না। বরং সরকার জানিয়ে দিচ্ছিল, তাঁর পরামর্শ গ্রহণযোগ্য নয়। এই কারণেই তিনি সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন প্রবীণ আইনজীবী।

অন্য দিকে, বর্তমান এজি কিশোর দত্তের আগে ওই পদে ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ। তিনি রাজ্যের এজি পদে যোগ দেন ২০২১-এর ১৪ সেপ্টেম্বর। মমতা তৃতীয় বারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে পরেই। তাঁর সঙ্গেও সরকারের দূরত্ব তৈরির জল্পনা ‌ছড়িয়েছিল। এর পর ২০২৩ সালের নভেম্বরে বিদেশে থাকাকালীনই রাজ্যপাল বোসের কাছে ইস্তফাপত্র পাঠান সৌমেন্দ্রনাথ। পরে জানিয়েছিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে তাঁকে হয়তো সরকারের আর দরকার নেই। উল্লেখ্য, তিনি এজি পদে থাকাকালীনই নিয়োগ দুর্নীতি থেকে রেশন দুর্নীতি-সহ বহু মামলায় নাম জড়িয়েছিল শাসকদলের।

প্রসঙ্গত, রাজ্যপাল যে ওই মামলাটি করছেন, তা আগেই জানা গিয়েছিল রাজভবন সূত্রে। মঙ্গলবার শিলিগুড়িতে এসে রাজ্যপাল নিজেও জানান, মামলাটি দায়ের হয়ে গিয়েছে। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। রাজ্যপাল বলেন, ‘কেউ যদি আমার সম্মান নষ্ট করার চেষ্টা করেন, তবে তিনি যিনিই হোন, তাঁকে ভুগতে হবে।’ পরে রাজ্যপালকে এ ব্যাপারে বিশদে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী আমার সাংবিধানিক সঙ্গী। আমি সেই হিসাবেই তাঁকে মর্যাদা দিই। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা নিয়ে মানহানির মামলা দায়ের হয়েছে। বাকিটা আদালত বিচার করবে।’

সম্প্রতি নবান্নের একটি সরকারি বৈঠক থেকে রাজ্যপালকে আক্রমণ করেছিলেন মমতা। রাজ্যের দুই হবু বিধায়কের শপথগ্রহণ নিয়ে রাজভবনের সঙ্গে রাজ্যের যে টানাপড়েন চলছে, সে ব্যাপারে মমতা বলেছিলেন, ‘জেতার পরেও এক মাস ধরে আমার বিধায়কেরা বসে আছেন! রাজ্যপাল শপথ নিতে দিচ্ছেন না। মানুষ ওঁদের নির্বাচিত করেছে। ওঁর কী অধিকার তাঁদের শপথ নিতে না দেওয়ার? উনি হয় স্পিকারকে শপথগ্রহণ করানোর অধিকার দিন, নয়তো ডেপুটি স্পিকারকে দিন। আর তা না হলে নিজে বিধানসভায় যান। ওঁর রাজভবনে কেন সকলে যাবে? রাজভবনে যা কীর্তি-কেলেঙ্কারি চলছে, তাতে মেয়েরা যেতে ভয় পাচ্ছে বলে আমার কাছে অভিযোগ করেছে।’ প্রসঙ্গত, যে দুই হবু বিধায়কের শপথগ্রহণ নিয়ে টানাপড়েন চলছে, তাঁদের এক জন মহিলা। তিনি তৃণমূলের সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। সায়ন্তিকা এক জন অভিনেত্রীও বটে। মুখ্যমন্ত্রী মমতার ওই মন্তব্যের জবাব আসে রাজভবন থেকে। রাজ্যপাল জানান, তিনি এক জন প্রশাসনিক প্রধানের কাছ থেকে এমন বিভ্রান্তিকর এবং রাজভবনের মর্যাদাহানিকর মন্তব্য শুনবেন বলে আশা করেননি। তার পরেই রাজভবন সূত্রে জানা যায়, রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার পথে হাঁটছেন। এরপরই মঙ্গলবার হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × 2 =