১ জুলাই থেকে দেশের আইনি ব্যবস্থায় বড় বদল এসেছে। দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে চালু থাকা ইন্ডিয়ান পিনাল কোড বা ভারতীয় দণ্ডবিধির অবলুপ্তি ঘটিয়েছে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার। ব্রিটিশ আমলের আইনের সমাপ্তি হয়ে লাগু হয়েছে নতুন আইন। সেই আইনের নাম দেওয়া হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা। আইনজীবী-বিচারকরা জানাচ্ছেন, পুরনো আইনের কিছু পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করেই নতুন আইন বানানো হয়েছে। বেশ কিছু নতুন আইন যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তেমন অনেক আইন অবলুপ্ত হয়েছে। আবার পুরনো অনেক আইনের পরিসর বৃদ্ধি করা হয়েছে ন্যায় সংহিতায়। সেই ন্যায় সংহিতাতে এবার এসেছে জিরো এফআইআর। যেখানে ঘটনা ঘটেছে যে থানার অধীনে সেখানেই যে অভিযোগ জানাতে হবে তার আর বাধ্যবাধকতা রইল না। যে কোনও থানায় জানানো যাবে অভিযোগ।
এর আগে আমজনতাকে অসহায় ভাবে দেখতে হয়েছে, যেখানে নিজেদের এলাকায় অপরাধ ঘটেনি বলে অভিযোগ নিতে চায়নি থানা। এ সব নিয়ে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর। আইনের জটিলতায় বিচার পায়নি সাধারণ মানুষ। দেশে আইনি ব্যবস্থা থাকলেও তা ন্যায় দিতে পারেনি নিপীড়িতকে। কিন্তু এই সমস্যার অবসান ঘটাতে নতুন আইনে করা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যার নাম জিরো এফআইআর। আইনের চোখে এটি এফআইআর-এর এক বিশেষ ধরন।
এখানে বলে রাখা শ্রেয়, এফআইআর কথাটির অর্থ ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট। জিরো এফআইএর-কে এক কথায় বলা যায় জুরিশডিকশন ফ্রি এফআইআর। অর্থাৎ যে কোনও অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা যাবে দেশের যে কোনও থানায়। এক জায়গায় ঘটা ঘটনার অভিযোগ অন্য থানায় নথিভুক্ত করলে করতে হবে জিরো এফআইআর। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা আরও সহজ হবে। ধরুন আপনার বাড়ি যাদবপুর থানা এলাকায়। কিন্তু আপনার সঙ্গে কোনও অপরাধ ঘটেছে বেহালা থানা এলাকায়। কিন্তু আপনি পরিস্থিতির কারণে বেহালা থানায় অভিযোগ জানাতে পারেননি। বাড়ি ফিরে অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে যাদবপুর থানাতেই আপনি অভিযোগ জানাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আপনাকে দায়ের করতে হবে জিরো এফআইআর। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা অনুযায়ী, যাদবপুর থানার পুলিশ আপনার সেই অভিযোগ নিতে বাধ্য। যাদবপুর থানা জিরো এফআইআর দায়ের করে, সংশ্লিষ্ট থানা অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বেহালা থানায় সেই অভিযোগ পাঠিয়ে দেবে। বেহালা থানা জিরো এফআইআর-এর ভিত্তিতে এফআইআর দায়ের করে ঘটনার তদন্ত শুরু করবে। অর্থাৎ এই নতুন ব্যবস্থায় অভিযোগ দায়েরের বিষয়টি কেবল ঘটনাস্থলের অন্তর্গত থানাতেই সীমাবদ্ধ রইল না। ফলে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের আরও সহজ হয়ে গেল।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় জিরো এফআইআর নিয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। সেখানে এই বিশেষ ধরনের এফআইএর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। তবে জিরো এফআইআর এই আইনের মাধ্যমেই ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় এল এমন নয়। আজ থেকে এক দশক আগেই জিরো এফআইআর নিয়ে সরব হয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আদালতের রায়ে এই বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। আদালতের নির্দেশে পুরনো আইনেই অ্যামেন্ডমেন্ড করে জিরো এফআইআর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু নতুন আইনের ধারায় এ নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। জিরো এফআইআর-এর চল আরও বাড়াতেই এই পদক্ষেপ। জিরো এফআইআর-এ যে সুবিধা মেলে, তা করতে অতীতে একাধিক বার নির্দেশ দিয়েছে দেশের বিভিন্ন আদালত। ১৯৯৯ সালে সতবিন্দর সিং ও রাজ্যের মধ্যে হওয়া মামলায় দিল্লি হাইকোর্ট জানিয়েছিল- কোনও মহিলা যে কোনও থানায় অভিযোগ জানালে সে অভিযোগ নিতে হবে। বিষয়টি সবথেকে বেশি গুরুত্ব পায় নির্ভয়া গণধর্ষণ মামলা ঘিরে। ২০১২ সালে নির্ভয়ার মৃত্যু ঝড় তুলেছিল গোটা দেশে। সেই মামলার প্রেক্ষিতেই বিচারপতি ভার্মার নেতৃত্বাধীন কমিটি জিরো এফআইআর চালু করতে বলে। এর পর ২০১৩ সালে সিআরপিসি-তে অ্যামেন্ডমেন্ট করা হয়। জিরো এফআইআর-এর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু তার পরও এ ধরনের অভিযোগ দায়ের নিয়ে টালবাহানা হয়েছে। এ রকম একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে। সময়ে সময়ে পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতেই জিরো এফআইআর গুরুত্ব পেয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায়।
জিরো এফ আইআর সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-
- যার সঙ্গে অপরাধের ঘটনা ঘটেছে তিনি জিরো এফআইআর দায়ের করতে পারেন। নির্যাতিত বা নির্যাতিতার পরিবারের লোক বা আত্মীয়, যিনি এই অপরাধের বিষয়ে জানেন, তিনিও জিরো এফআইআর দায়ের করতে পারেন।
- জিরো এফআইআর কেবল মাত্র খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চুরি, পণের জন্য অত্যাচারের মতো ঘটনাগুলির ক্ষেত্রেই দায়ের করা যায়।
- লিখিত ভাবে জিরো এফআইআর দায়ের করতে হবে।
- যে থানায় জিরো এফআইআর দায়ের হচ্ছে, ঘটনাস্থল সেই থানার অন্তর্ভুক্ত হলে চলবে না। যে থানার অধীনে অপরাধ ঘটেছে, সেখানে জিরো এফআইআর দায়ের করা যায় না। সেই থানা ছাড়া বাকি যে কোনও থানায় ওই সংক্রান্ত অভিযোগ জানাতে এই ধরনের এফআইআর দায়ের করা যায়।
- এই ধরনের এফআইআর নম্বর সব সময় শূন্য দিয়ে শুরু হয়।
- জিরো এফআইআর যখন সংশ্লিষ্ট থানায় স্থানান্তরিত করা হয়, তখন তা যেভাবে দায়ের হয়েছে, সেভাবেই স্থানান্তরিত করতে হয়।
- যে থানায় এফআইআর দায়ের হল, সেই থানার অফিসাররা ঘটনার তদন্ত করেন। কিন্তু জিরো এফআইআর যে থানায় দায়ের হল সেই থানার অফিসাররা এই ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে না। সংশ্লিষ্ট থানায় তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে জিরো এফআইআর যে থানায় দায়ের হয়েছে, সেই থানা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করতে পারে।
- সাধারণ এফআইআর দায়ের করতে কিছু নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হয়। কিন্তু জিরো এফআইআর-এর ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ নেই।
জিরো এফআইআর করার কিছু আবশ্যিক বিষয়-
- যিনি জিরো এফআইআর করছেন, এফআইআর-এ তাঁর নাম, ঠিকানার বিস্তারিত উল্লেখ করতে হবে।
- কোন স্থানে, কখন, কোন তারিখে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে।
- অভিযোগকারী বা অভিযোগকারিণী যদি অভিযুক্তদের সনাক্ত করে থাকেন, তাহলে অভিযুক্তদের নাম উল্লেখ করতে হবে।
- যদি ঘটনার কোনও সাক্ষী থাকে। তাহলে সেই সাক্ষীর নামও অভিযোগকারীকে উল্লেখ করতে হবে।
- নির্যাতিত বা তাঁর সহযোগী যিনি অভিযোগ দায়ের করছেন, তাঁকে স্বাক্ষর করতে হবে।
- জিরো এফআইআর দায়েরের পর তার কপি বিনামূল্যে অভিযোগকারীকে দিতে হবে।
- এর পর যে থানায় জিরো এফআইআর দায়ের হল, সেই থানা ওই এফআইআর সংশ্লিষ্ট থানাতে পাঠাবে। সেখানে জিরো এফআইআর-এর ভিত্তিতে নতুন করে এফআইআর দায়ের হবে।
- এরপর সংশ্লিষ্ট থানা ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত শুরু করবে। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে যে থানায় জিরো এফআইআর দায়ের হয়েছে, সেই থানার অফিসাররাও তদন্তের প্রাথমিক কাজ শুরু করতে পারেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কোনও মহিলা যদি ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনার জিরো এফআইআর দায়ের করেন। যে থানায় তিনি জিরো এফআইআর দায়ের করা হয় সেই থানার অফিসাররা নির্যাতিতাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করাতে পারেন।
জিরো এফআইআর গুরুত্বপূর্ণ কারণ, অপরাধের ঘটনা ঘটার পর অভিযোগ দায়ের হতে দেরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে পারবে এই এফআইআর। তা হলে তদন্তও দ্রুত শুরু হবে। জিরো এফআইএর হলে অন্য থানাও সেই অভিযোগ নিতে বাধ্য থাকবে। এতে অপরাধের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের সম্ভাবনা বাড়বে। দ্রুত তদন্ত শুরু করাও সম্ভব হবে বলে আশা। এর পাশাপাশি ধর্ষণ, অপহরণ, খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা সহজ হবে। কোনও থানা অভিযোগ নিতে না চাইলে, অন্য থানার মাধ্যমে অভিযোগ করা যাবে।
জিরো এফআইআর পুরোদমে ব্যবহৃত হলে দেশের নাগরিকদের অভিযোগ দায়ের করা আরও সহজ বলে দাবি আইনপ্রণেতাদের। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় সেই পরিসর তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কড়া আইন আর শাস্তির বিধান করলেই যে অপরাধ কমে যাবে এমন নয়। এর জন্য প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। যার দায়িত্ব পুলিশের কাঁধে। রাজনৈতিক প্রভাবেই হোক বা অসৎ পুলিশ অফিসারের মর্জি। অতীতে অভিযোগ দায়ের না করা, অভিযোগের যথাযথ তদন্ত না করা নিয়ে আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছে প্রশাসনকে।