আদ্যন্ত ‘চলচ্চিত্রকার তপন সিনহাকে সম্মান কেআইএফএফ-এর

‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’- আতংকের এই সংলাপ আজকের ভাষায় ‘কাল্ট’, তা তৈরি হয়েছিল তপন সিনহার হাতেই। বৈচিত্রই তপন সিংহের প্রতিশব্দ। তিনি রবীন্দ্রনাথেও আছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েও। শরদিন্দুতে, আবার শংকরেও। বনফুলে যেমন, গৌরকিশোরেও। আবার খবর কাগজের রিপোর্টিং থেকেও তুলে নিয়েছেন ছবির বিষয়। ‘বোরিং’ হতে চাননি কখনও। তাঁর ‘দু’টি হাতের একটি হয়তো সব সময় কোয়ালিটির সন্ধান করে বেড়াত আর অপর হাতটি ধরা থাকত জনসাধারণের হাতের সঙ্গে,’ তরুণ মজুমদার লিখে গেছেন এ কথা, তপন সিনহা সম্পর্কেই। ছবির বিষয় বাছা থেকে শুরু করে চিত্রনাট্য, কাস্টিং, সঙ্গীত, অভিনয়, শুটিং, পোস্ট-প্রোডাকশন থেকে ছবির মুক্তি অবধি যে একটা দীর্ঘ যাত্রা, সেই ‘জার্নি’টা তিনি হেঁটেছেন সবাইকে নিয়ে। প্রতিবারই বুঝিয়ে ছেড়েছেন চলচ্চিত্র কী বস্তু, কোথায় তার রস, কেন সে শিল্প। পাঁচ দশকব্যাপী দীর্ঘ ছবিজীবনে ছোট-বড় মিলিয়ে এতগুলো ছবি বানিয়েছেন তিনি যে, তাঁর ফিল্মোগ্রাফি মনে রাখাটাই শক্ত। তবু তপন সিনহা বলতেই এক ঝলকে মনে আসবে বেশ কয়েকটা ছবির নাম। যে তালিকায় রয়েছে ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘জতুগৃহ’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘আতঙ্ক’। কোনও ভাবেই বাঙালি ভুলতে পারবে না ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘অতিথি’, ‘হাটে বাজারে’, ‘সাগিনা মাহাতো’-র মতো ছবিকেও। মনের কোথাও একটা উঁকি দেবে ‘এখনই’, বা ‘হুইল চেয়ার’-এর কথাও।

বৈচিত্র্যে ভরা তপন সিনহার একটা ছবির পরই ছবি এমন এক স্থান-কাল-পাত্রপাত্রীকে তিনি বেছেছেন যার মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত এক বৈপরীত্য। যেমন, ‘ঝিন্দের বন্দি’-র পরের ছবি ছিল ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’। আর যাঁদের নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নক্ষত্র বললেও ভুল হবে না। ছবি বিশ্বাস বা ছায়া দেবীকে হাতে ধরে বসিয়ে দিচ্ছেন বিশ্বস্তরের চলচ্চিত্রাভিনয়ের তখ্‌তে। তার ছবিতে আমরা পেয়েছি উত্তমকুমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে অশোককুমার, দিলীপকুমার, সায়রা বানু, বৈজয়ন্তীমালা, মাধবী মুখোপাধ্যায়, রুমা গুহঠাকুরতা, শর্মিলা ঠাকুর, তনুজা, অপর্ণা সেন, শাবানা আজমি আর অরুন্ধতী দেবী তো বটেই। একইসঙ্গে বাংলা সিনেমাকে উপহার দিযেছেন অজিতেশ-রুদ্রপ্রসাদ থেকে মনোজ মিত্রকে। বাঙালি দর্শকদের চিনিয়েছেন স্বরূপ দত্ত বা শমিত ভঞ্জকে। তপন সিনহাকে আমরা কি সত্যিই বুঝতে পেরেছিলাম, এটা এই মুহূর্তে লাখ টাকার প্রশ্ন। এককথায় উত্তরটা বুঝতে পারিনি, বুঝতে হয়ত চাইনিও। একদা ত্রুফো, গোদার, বার্গম্যানকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত আমরা তপনের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলাম তাচ্ছিল্যের হাসি। এই যে জতুগৃহ (১৯৬৪) ছবিটিতে সামান্য চাকুরিজীবী সুপ্রিয় (অনিল চ্যাটার্জি), শতদলের (উত্তমকুমার) অনুগ্রহের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে, তা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, সেই মধ্যবিত্তের জীবন কোথায় গেল? তার আত্মবিশ্বাস কত প্রচ্ছন্ন থাকত! তপন সিনহা তো চিরকালই বাঙালি কেরানি এবং তলার দিকের অফিসারদের গৃহসম্পদ ছিলেন। তাঁর ছবি লোকে দল বেঁধে দেখতে যেত, পারিবারিক আনন্দ হিসাবেই। তবে এই মুহূর্তে বাঙালির কাছে নস্ট্যালজিয়া। সুতরাং তপনবাবু ফিরে আসছেন। একুশ শতকে এসে এখন যখন বাংলা ছবি একদিকে উচ্চবিত্তের সম্পর্ক-সমস্যা বা অন্য নানারকম অতিপ্রাকৃতিক গল্প, অন্যদিকে নিম্নবিত্তের প্রান্তিকতা, লুম্পেন রেটোরিক ধরতে চাইছে তখন বলতেই পারি বঙ্গ সামাজিক আঙিনায় তপনের কাজের জন্যেও আলাদা একটি পরিসর তৈরি করেছিল।

বাংলা ছবির ঐতিহ্য বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা না থাকায় আমরা বুঝতেই পারিনি, ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) বা ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬)-তে ছোট্ট অপুর মুখে যখন প্রায় কোনো সংলাপই দেওয়া হয় না, তখন ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৫৭) ও ‘অতিথি’ (১৯৬৫)-তে শিশুশিল্পীরাও সংলাপে অসাধারণ দক্ষতা অভিভূত করেছিল সকলকেই। আসলে তপন ছিলেন নিউ থিয়েটার্সের সন্তান। যে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও বাঙালিকে সিনেমা চিনিয়েছিল এবং সিনেমা বলতে গল্প, বা বই, বুঝিয়েছিল। তপন নিজের পথ করে নিয়েছিলেন হলিউডের জন ফোর্ড আর উইলিয়াম ওয়াইলারের মাঝখান দিয়ে। তপন বিশ্বাস করতেন সিনেমা স্বয়ংশাসিত হলও তাকে গল্পের উপর নির্ভরশীল থেকে যেতে হবে আর সেই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বিচিত্র পথে। যে ওয়াইলার ‘রোমান হলিডে’ (১৯৫৩)-র মত পেলব গীতিকবিতা লেখেন, তিনিই ‘বেন হুর’ (১৯৫৯) ছবির ব্যাপ্ত পটভূমি মেলে ধরেন। যে ফোর্ড ওয়েস্টার্ন গোত্রের মরুপ্রান্তরে পাথরের এক্সট্রিম লং শটকে অমর করে রাখেন, তিনিই মৃত্তিকার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখেন ‘হাউ গ্রিন ওয়াজ মাই ভ্যালি’ (১৯৪১)-তে। সুদূর বাংলায় গল্প বলার দেশে জন্মে, অন্তহীন গল্প শুনতে শুনতে, শরৎচন্দ্রের প্রত্যক্ষ ঐতিহ্যে নিজেকে শিক্ষিত করতে করতে তপনের হয়তো মনে হয়েছিল তাঁর কোনো অধিকারই নেই এই ধারা থেকে বিযুক্ত হওয়ার। আলো, শব্দ, ছবি দিয়ে বলে যেতে হবে নানারকম বিচিত্র স্বাদের কাহিনিমালা। সব মিলিয়ে তপন সিনহা স্রেফ ‘চিত্রপরিচালক’ নন, তপন সিনহা আদ্যন্ত ‘চলচ্চিত্রকার’, ‘ফিল্মমেকার’।

তপন সিনহাকে নিয়ে আরও একটা কথা না বললেই নয়, কাজের সময় গলার আওয়াজ কখনও বাড়ত না এক ফোঁটাও, অথচ যা বলার আর করার তা ঠিক হয়ে যেত। তপন সিনহার ক্ষেত্রে এই ‘ট্রু জেন্টলম্যানশিপ’টি চোখ চেয়ে দেখার তো বটেই, শেখারও। আর ৩০ তম কলকাতা ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভ্য়ালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ’গল্প হলেও সত্য়ি’ সিনেমা প্রদর্শনে এই ট্রু জেন্টেলম্য়ানকে  সম্মান জানিয়ে শুরু হয় পথ চলা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty − fourteen =