গায়ক থেকে নায়ক, শতবর্ষে তালাতকে সম্মান 

গজলকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের পুরোধা হিসেবে ধরা হয় তালাত মাহমুদকে, বাংলা সঙ্গীত জগতে একসময় যিনি পরিচিত ছিলেন তপন কুমার নামে। এই তালাত মাহমুদের গান শুরু হয়েছিল গজল দিয়ে লখনউয়ে, ১৯৩৯ সালে ম্যারিস কলেজে। পরে যার নাম বদলে ভাতখণ্ডে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়। ১৯৩৯-এ, বয়স তখনও মোটে ষোলো, তখনই লখনউ রেডিয়োতে ওঁর গাওয়া মীর, দাগ, জিগরের গজলের সুরভি বিস্তারিত হতে শুরু করে সারা ভারতে। এরপর উর্দু, হিন্দির সঙ্গে শুরু বাংলা গানের পথচলা। কলকাতায় পা রেখে কমল দাশগুপ্তের সুরে পরপর ক’টা বাংলা গানও গাইলেন, যার প্রথমটি (শোনো গো সোনার মেয়ে, ১৯৪৪)। পরের গান (সুর কমল দাশগুপ্ত), কথা (গিরীন চক্রবর্তী) অবাক-করা। ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’ (১৯৪৫)-তে তালাতের বাংলা উচ্চারণটাও ছিল বড়ই বাঙালি। এরপর এই তালিকায় যোগ হয় কমল দাশগুপ্ত, পবিত্র মিত্র, শ্যামল মিত্র, শ্যামল গুপ্ত, কানু ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, ভি. বালসারা, রবীন চট্টোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের কথায় ও সুরে আরও বেশ কিছু গান। যে তালিকায় রয়েছে  ‘আলোতে ছায়াতে’, ‘চাঁদের এত আলো’, ‘ঘুমেরও ছায়া’, ‘এই তো বেশ এই নদীর তীরে’, ‘যেথা রামধনু ওঠে’, ‘সে কোন শাওনি মেঘ’, ‘অনেক সন্ধ্যাতারা’, ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও’, ‘শোনো গো সোনার মেয়ে’, ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়’, ‘এই রিমঝিম ঝিম বরষায়’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর গাওয়া ‘এ যদি আকাশ হয়, তোমায় কী বলে আমি ডাকব বল’ বাংলা গানকে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা।
১৯৪৪-এই তালাত-ই গেয়ে ফেলেন ওঁর বেসিক হিন্দি হিট ‘তসবির তেরি দিল মেরা ব্যাহেলা ন সকেগি’। আজও নন-ফিল্মিক রেকর্ডের বিক্রির তালিকায় ওপরের দিকে থেকে গেছে এই গানটা। এই গানের সাফল্যই ওঁকে কলকাতায় বানানো তিনটে হিন্দি ছবির নায়কের রোলও পাইয়ে দেয়। যার দুটোতে কাননদেবী (‘রাজলক্ষ্মী’ আর ‘তুম অউর ম্যাঁয়) আর একটিতে ভারতী দেবী (‘সমাপ্তি’)।
এরপর ১৯৪৯-এ, বোম্বাই পাড়ি দেন তালাত। অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই ছিল, তবে তত দিনে বড় টান হয়েছে বম্বেতে প্লে-ব্যাক গাওয়ার। কলকাতা থেকেই ওঁর নাম পৌঁছেছিল বম্বেতে, তাতে একটার পর একটা অফার এসেই চলেছিল। কিন্তু বম্বেতে তালাত মাহমুদের ‘তালাত মাহমুদ’ হয়ে ওঠার শুরু অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘আর্জু’ ছবিতে ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সি জগহ লে চল যঁহা কোই ন হো’ গেয়ে।
বম্বের ছবির সাউন্ডট্র্যাকে যিনি গজলের স্টাইলকে মসৃণভাবে বুনে দিয়েছিলেন সেই অনিল বিশ্বাসই যেন হিন্দি গানে তালাতের গায়কির ছায়াপথ নির্দিষ্ট করে দিলেন। বাংলায় বেসিক গানে যেমন ওঁর গজল স্টাইলের অনুচ্চ স্বরতরঙ্গকে কাজে লাগিয়েছিলেন তেমনই হিন্দি ফিল্মগানেও তখনকার বাংলা গীতিধারার মূর্ছনা ও আবেশ বয়ে এনেছিলেন। ওঁর অনেক হিন্দি প্লে-ব্যাকে শ্রোতা যেন এক বাঙালি কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়। যার সম্য়ক প্রতিফলন বাঙালি পরিচালক বিমল রায়ের বাঙালি জীবন নিয়ে তৈরি ‘সুজাতা’ ছবিতে বাঙালি সুরকার শচীনদেব বর্মনের নির্মিত ‘জ্বলতে হ্যায় যিসকে লিয়ে’ গানে। পর্দায় গানটা নায়ক সুনীল দত্ত টেলিফোনে গেয়ে শোনাচ্ছেন নায়িকা নূতনকে। দৃশ্যের বাঙালি আমেজটা সম্পূর্ণ হয়েছে তালাতের একটা প্রায় নিখুঁত বাঙালি আওয়াজে।
এই কণ্ঠে মজেই সলিল চৌধুরী ওঁর সুরারোপিত দুটি হিন্দি ছবির তিনটি অবিস্মরণীয় গানে তালাতের গলা নিয়েছেন। তার একটি ‘ইতনা ন মুঝসে তু পিয়ার বঢ়া’, যা অর্ধশতাব্দীকাল পেরিয়েও ঘুরেছে ঠোঁটে ঠোঁটে। দ্বিতীয় গানটাও কানে বসে আছে বাঙালির, কারণ এর সুর নির্ভুল ভাবে সলিলীয়। হিন্দিতে গানটা ডুয়েট ছিল তালাত ও লতার। ‘আহা রিম ঝিম কে ইয়ে পিয়ারে পিয়ারে গীত লিয়ে’। সুরটাকে বাংলাতে গেয়েছেন শ্যামল মিত্র-‘আহা, ওই আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে’।
আর তৃতীয় গানটাও ‘ছায়া’ ছায়াছবির। ‘আঁসু সমঝ কে কিঁউ মুঝে আঁখসে তুমনে গিরা দিয়া’। রাজিন্দার কৃষণের কথায় ধরা এই গানের বাংলা ভার্সানে সলিল কথা বসিয়েছিলেন, ‘কী যে করি, কী যে করি/দূরে যেতে হয় তাই/ সুরে সুরে কাছে যেতে চাই’। লতাকে দিয়ে গাওয়ানো সে গান বাংলায় ক্ল্যাসিক হয়ে আছে।
এরই পাশাপাশি ভোলা যাবে না ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে’, ‘যায়ে তো যায়ে কাঁহা’, ‘ফির ওহি শাম’, ‘অ্যায় মেরে দিল কাঁহি  অউর চল’, ‘রাত নে কেয়া কেয়া খোয়াব দিখায়ে’, ‘রাহি মতওয়ালে’, ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সি জগা লে চল’, ‘রো রো বিতা জীবন সারা’-র মতো গানগুলোও। শুধু গানই নয়, বাংলাকেও ভালোবেসে ফেলেছিলেন তালাত। জীবনসঙ্গিনীও নির্বাচন করেছিলেন লতিকা মল্লিককে, যিনি ছিলেন একজন বাঙালি খ্রিস্টান। ভালোবাসা দিয়ে মুছে ফেলেছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের সব বাধা-বিপত্তি।
তালাতের ‘ওপরওয়ালার দান’ বলতে ছিল কণ্ঠের পাশাপাশি মুখেরও অপরূপ শ্রী। যার জেরে ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৮-র মধ্যে অভিনয় করে ফেলেন ডজনখানেক ছবিতেও। শুরুতে নায়িকা হিসেবে  ‘রাজলক্ষ্মী’ ছবিতে পান কাননবালাকে। শেষ করলেন নূতনকে নায়িকা পেয়ে ‘সোনে কি চিড়িয়া’ ছবিতে। মাঝখানে নায়িকা হয়েছেন মধুবালা, সুরাইয়া, শ্যামা, রূপমালা, শশীকলা, মালা সিনহার গ্ল্যামারাস অভিনেত্রীরা।
তালাত সম্পর্কে দিলীপ কুমার তালাতকে দেখে তো বলেই ফেলেছিলেন, ‘মানুষটার ভদ্রতা ওঁর চেহারায় বেরিয়ে আসে।’ আরও এক প্রতিভাধর বাঙালি গায়ক সুবীর সেন বলেছিলেন, ‘তালাত মাহমুদের ভদ্র, সুজন ব্যক্তিত্বের একটা তুলনা হতে পারে রাহুল দ্রাবিড়। নির্ভরশীল ও কীর্তিমান, কিন্তু প্রচারের আলোকবৃত্ত থেকে সরে। তাঁর এই নির্জনতাটাই ফুটে ওঠে শ্যামল গুপ্তের কথায় আর ভি বালসারার সুরে- ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও-এ।’ বাঙালি আজও তাঁর কণ্ঠস্বরেই যেন খুঁজে পায় চাঁদের চোখে নেমে আসা ঘুমের ছায়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 + two =