‘মোস্ট কমপ্লিট সিঙ্গার’ মহম্মদ রফিকে শতবর্ষে স্মরণ

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যাঁদের বহু শিরোপাধারী গানও হারিয়ে যায় স্মৃতির ডাস্টবিনে।‌ অথচ রফি, মুকেশ, কিশোরদের গান শুনতে গিয়ে সবাই ভোলেন সময়ের পাকদণ্ডী। ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে একসময় সমগ্র উপমহাদেশে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহম্মদ রফি। প্রায় চল্লিশ বছর সময়কাল ধরে সঙ্গীত জগতে থাকাকালীন তিনি ছাব্বিশ হাজারেরও অধিক চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্য গায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন মহম্মদ রফি। বিশেষজ্ঞের মতে, রফি ছিলেন ‘মোস্ট কমপ্লিট সিঙ্গার’। রাগাশ্রয়ী থেকে ভজন, রোম্যান্টিক থেকে গজল, হিপহপ থেকে রক-অ্যান্ড-রোল থেকে কাওয়ালি বা ডিস্কো। এবং আরও অনেক কিছু।
১৯২৪ সালে অবিভক্ত পঞ্জাবের কোটা সুলতান শাহ গ্রামে জন্মেছিলেন মহম্মদ রফি। ছোট থেকেই যেমন ছিলেন গান পাগল, ঠিক তেমনই তাঁর গলার সুর বুঝিয়ে দিয়েছিল তিনি সাক্ষাৎ সরস্বতীর বরপুত্র। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সায়গলের প্রশংসা বা ১৪ বছর বয়স থেকে আকাশবাণীর লাহোর কেন্দ্রে গান করা-সবই তাঁর প্রতিভার প্রমাণ।
১৯৪২ সালে শ্যামসুন্দরের সুরে গুল বালোচ ছবিতে তিনটি গান গেয়েছিলেন। প্রথম গান ছিল ‘সোনিয়ে নি/ হেরিয়ে নি/ তেরে ইয়াদ নে আন সতায়া’। এরপর গান রেকর্ড করতে ১৯৪৩ সালে বোম্বে শহরে আসেন রফি। কারণ গ্রামের মেলায় নিজের গান শুনে রফির মনে হয়েছিল হয়তো কিছু করা সম্ভব। এরপরই বোম্বেতে শ্যামসুন্দর তাঁকে গাঁও কি গোরি – দ্য ভিলেজ গার্ল ফিল্মে সুযোগ দিলেন (‘ইয়ার কি অ্যায়সি কি ত্যায়সি’) কিন্তু সেটা প্রকাশের আগেই বেরিয়ে গেলো নওশাদের সুরে ‘হিন্দুস্তান কে হাম হ্যাঁয়’। ফলে কার্যত এটাই প্রথম প্রকাশিত রেকর্ড। এদিকে রফি অনুরাগীদের একটা বিরাট অংশের ধারনা, বৈজু বাওরা-র আগে তিনি নাকি একেবারেই বিখ্যাত ছিলেন না। তবে এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। মেলা (‘ইয়ে জিন্দেগি কে মেলে’), শহিদ (‘ওয়াতন কি রাহ মে’), জুগনু (‘ইয়াহাঁ বদলা ওয়াফা কা বেওয়াফা কে’), তেরা খিলোনা টুটা বালক কিংবা অন্দাজ (‘বচপন কে দিন ভুলা না দেনা’) এই রকম বেশ কয়েকটি গান বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল। মহম্মদ রফির শুধু হিন্দি ফিল্মে প্রকাশিত গানের সংখ্যা বৈজু বাওরার আগে ছিল ২৫০-এর বেশি। আর এই সব গানের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘ফিল্ম ফেয়ার’, ‘পদ্মশ্রী’, ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কার’ সবই। ভজন হোক বা নাদ, গজল হোক বা দেশাত্মবোধক, চটুল হোক বা রাগপ্রধান, কোনও গানেই দুর্বল ছিলেন না রফি।
মহম্মদ রফি ঠিক ক’টা গান গেয়েছেন তা নিয়ে চর্চা এখনও চলে। তবে তাঁর দীর্ঘ এই তালিকায় রয়েছে হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, মারাঠি, কোঙ্কনি, গুজরাটি, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, ছত্তিশগড়িয়া, ওড়িয়া, অসমিয়া, বাংলা, মৈথিলী, ভোজপুরী, অওধি, ব্রজভাষা। এই সতেরোটা ভারতীয় ভাষা ছাড়াও গান গেয়েছেন ইংরেজি, ডাচ, মরিশাসের ভাষা, ক্রেওল, আরবি, ফারসি (দারি) এই ছটা বিদেশি ভাষায়। এর মধ্যে ডাচ গানটি লাইভ রেকর্ড বলে অনেকে হিসাবের মধ্যে রাখেন না।নেপালি ভাষায় গান করেননি, কিন্তু একটি গানের প্রথম লাইন ছিল নেপালি (আজকো জুনলি রাতমা)।
বাংলায় প্রথম গান ‘ওই দূর দিগন্ত পারে’ আর ‘নাই বা পরিলে আজ মালা চন্দন’। কথা পবিত্র মিত্র, সুর বিনোদ চট্টোপাধ্যায়। স্বয়ং মহম্মদ রফিও বড় ভক্ত ছিলেন নচিকেতা ঘোষের সুরের। কিন্তু নচিকেতা ঘোষের সুরে কোনও গান গাওয়া হচ্ছিল না তাঁর। সুযোগ হয় ‘ইন্দ্রানী’ ছবিতে। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির পরিচালক ছিলেন নীরেন লাহিড়ি। উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত এই ছবির সবকটি গানই অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবু, তার মধ্যে একটি গান নচিকেতা ঘোষ সুর করেছিলেন মহম্মদ রফিকে ভেবেই। গানটি ছিল, ‘সভি কুছ লুটাকর’। এই গানটির সুর যখন মহম্মদ রফি শোনেন, তাঁর এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে, গানটি তিনি বিনা পারিশ্রমিকে গেয়েছিলেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় এবং নচিকেতা ঘোষের সুরে মহম্মদ রফি যখন কণ্ঠ দেন, সে গান কালজয়ী হবে না তো কোন গান হবে! এর পাশাপাশি গেয়েছেন নজরুলগীতি, কথা ছিল শ্যামাসঙ্গীত গাইবেন। হয়ে ওঠেনি। তবে শুধু বিনোদ চট্টোপাধ্যায় নন, গেয়েছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, বাসু-মনোহরির সুরেও। আর হিন্দিতে তো ছিলেনই। শঙ্কর-জয়কিষন, ও পি নাইয়ার, শচীন দেববর্মন, রাহুল দেববর্মন, নওশাদ, চিত্রগুপ্ত, কল্যাণজি-আনন্দজি, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, রবি, সর্দার মল্লিক, সলিল চৌধুরী আরও কতো! এই মুহূর্তে যখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়েছে, তখন মনে পড়ে এই লোকটির গান ছাড়া রামনবমী পালন হয় না (‘রামজি কি নিকলি সওয়ারি’), আবার মেহনতি মানুষের গানও এঁরই কণ্ঠে ধ্বনিত হয় (‘হম মেহনতওয়ালোঁ নে জব ভি মিলকর কদম বঢ়ায়া, সাগর নে রাস্তা ছোড়া পর্বত নে শিশ ঝুকায়া, সাথী হাত বঢ়ানা)। একইসঙ্গে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর গন্ডি টপকে ইনি পৌঁছে যান পাকিস্তানে। আবার ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশের বাঙালিরাও এঁর গানে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। লন্ডনের সুরম্য অট্টালিকা থেকে বোম্বের ধরভি বস্তি, টোকিও থেকে কলকাতার কোনও শান্ত বাঙালি পাড়াতেও চলে রফির গান। তিনি না থাকলেও আজকের এই অশান্ত ভারতে তিনি হারিয়ে যাওয়া এক সমাজের চিহ্ন, যা চেষ্টা করলেও মুছে ফেলা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − seven =