উত্তমকুমারের অকাল প্রয়াণের পরে এক জোরালো ধাক্কা লাগে বাংলার মূলধারার সিনেমায়। তারই জেরে বিংশ শতাব্দীর আটের দশকের শেষ থেকেই বাংলা ছবির বাজারে সমান্তরাল ধারার ছবির প্রযোজক পাওয়ার সমস্যা বাড়ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের পক্ষেও ভরতুকি দিয়ে ছবি করার প্রযোজনা ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রেও উৎসাহ তেমনভাবে দেখা যাচ্ছিল না। শুধু তাই নয়, কম টাকায় আবেগপূর্ণ পারিবারিক ছবি ভালো ব্যবসা করায় এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আঙ্গিনায় বাংলা ছবির সাফল্য প্রার্থিত উচ্চতায় না আসার ফলে প্রযোজকের সংখ্য়াও কমছিল। এর পাশাপাশি ছিল মিডিয়ার তৈরি আর্ট ফিল্ম বনাম কমার্শিয়াল ফিল্ম এর দ্বন্দ্ব। যাতে বাংলা ছবির ছোট বাজার দ্বিধা বিভক্ত হয়। এই সময় থেকেই উঠে আসতে শুরু করেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলেন্দুর মতো পরিচালকেরা। নজর কাড়েন প্রভাত রায়, বীরেশ চট্টোপাধ্যায় অঞ্জন চৌধুরী, সুজিত গুহ ,স্বপন সাহাও। এমনই এক উদ্বেল আবহে উৎপলেন্দুর প্রথম ছবি ‘ময়নাতদন্ত’ বন্ডেড লেবারদের সমস্যার কথা যেমন তুলে ধরে, তেমনই অন্যদিকে স্মিতা পাতিল অভিনীত ‘দেবশিশু’ তুলে ধরে ছড়িয়ে থাকা নানা সামাজিক কুসংস্কারগুলোকে। তবে রাজনীতি সচেতন চলচ্চিত্র পরিচালক বলতে যা বোঝায় উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ছিলেন ঠিক তেমনই। কারণ, তিনি মনে করতেন,পলিটিক্স মাইনাস করলে ফিল্ম হয় না। আপডেট থাকতে হয়। চোখ কান বন্ধ রেখে ছবি করা যায় না।
এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, আশির দশকে ‘ময়নাতদন্ত’, ‘চোখ’, ‘দেবশিশু’র মতো একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত হন পরিচালক উৎপলেন্দু। ১৯৮২ সালে ‘চোখ’ ছবিটি ‘সেরা ছবি’র সম্মান জিতে নেয়। ‘চোখ’ ছবিটির পোস্টার এঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। ‘চোখ’ কাস্ট স্ট্রাগলকে মাথায় রেখে তৈরি। এই ছবির প্রধান স্তম্ভ অবশ্যই প্রতিবাদী শ্রমিক নেতার চরিত্রে ওমপুরী এবং একজন শিল্পপতির চরিত্রে কলকাতার নাট্যজগতের গর্ব শ্যামানন্দ জালানের অসামান্য অভিনয়। কিন্তু মালিকের সঙ্গে হাত মেলানো উঁচুতলার শ্রমিক নেতাদের মুখোশ খুলে দেন উৎপলেন্দু, যখন ওম পুরী অভিনীত যদুনাথ এক বৈঠকে ঢুকে পড়ে বাইরে থেকে আসা পদস্থ শ্রমিক নেতাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ‘মিউচুয়াল হো গিয়া না?’ এই ছবির আরও একটা দৃশ্য মনে গেঁথে যায়, যখন দেখা যায় মালিকের পাঠানো ভাড়াটে খুনি খুন করে লাশের গায়ে হাতে লেখা লাল অক্ষরের পোস্টার ফেলে যায়, ‘কমরেড যদুনাথের নেতৃত্বে শ্রেণি শত্রু খতম চলছে, চলবে!’ এই ছবিতে পরিচালক কোনও ইচ্ছাপূরণের গল্প লেখেননি বলেই বাঙালি তাঁর সততা ও ইতিহাস চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
তবে ১৯৭৬-এ উৎপলেন্দু নজর কাড়েন তাঁর প্রথম তথ্যচিত্রে, ‘মুক্তি চাই’। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আদিবাসীদের মধ্য়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এই তথ্যচিত্রটি তৈরি। যেখানে তুলে ধরা হয়, রাজনৈতিক কারণে বিনা বিচারে থাকা কারাবন্দিদের কথা। এরপর উৎপলেন্দুর প্রথম ছবি ‘ময়নাতদন্ত’ (১৯৮০)। ওঁর নিজেরই লেখা গল্প নিয়ে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখতেই হয়,পরে একটা গল্পসংগ্রহও বের হয়েছিল উৎপলেন্দুর। তবে স্বনামে না, ছদ্মনামে। সেই ছদ্মনাম– স্বর্ণ মিত্র। ‘ময়না তদন্ত’ (১৯৮০) ছবিতে একটি গানের নেপথ্য গায়কও ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেবশিশু’ ছবিতে যেভাবে গ্রামীণ ভারতবর্ষে প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার নির্ভরতার উৎস হিসাবে সীমাহীন দারিদ্র্য ও অশিক্ষাকে চিহ্নিত করেছিলেন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ,তা আজও সমাজ সচেতন চলচ্চিত্র পরিচালকদের কাছে এক উদাহরণ। ওম পুরী ও স্মিতা পাতিলের দুর্দান্ত অভিনয়ের তুলনায় এতটুক বেমানান ছিলেন না তখনও পর্যন্ত তেমন পরিচিতি না পাওয়া সাধু মেহের। এক দরিদ্র গ্রাম্য দম্পতির শারীরিক প্রতিবন্ধী পুত্রকে দৈবী ক্ষমতাসম্পন্ন সাজিয়ে ব্যবসা করার আয়োজনকে যেমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনা করেছিলেন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, ঠিক তেমনই তুলে ধরেছেন গ্রাম্য দম্পতির টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে বুজরুকির কারবারে যুক্ত থেকে চটজলদি রোজগারের প্রলোভনের ফলে তৈরি হওয়া এক মানসিক টানাপোড়েনের ঘটনাও। বর্তমান প্রেক্ষিতেও ছবিটি বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার নিরিখে প্রবল ভাবেই প্রাসঙ্গিক। বিশেষত সাধু মেহের অভিনীত রঘুবীর চরিত্রের সংলাপ। উৎপলেন্দুর পরিচালিত শেষ উল্লেখযোগ্য কাহিনীচিত্র ‘প্রসব’ ফের প্রমাণ করে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর নিজস্ব বিচরণভূমি হল রাজনৈতিক ছবি। আর সঙ্গীতে বিশেষ দখল ছিল উৎপলেন্দুর, তার প্রমাণ আমরা পাই ‘ছন্দনীড়’(১৯৮৯) ছবিটিতে। সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর সাফল্য নেপথ্য কন্ঠশিল্পী হিসাবে এই ছবির জন্য পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী এবং সেরা গীতিকার হিসাবে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি ।
উৎপলেন্দু সম্পর্কে আরও একটা কথা না বললেই নয়। চলচ্চিত্রকার হিসেবে ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনকে উৎপলেন্দু শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তাঁর প্রাণের প্রিয় ছিল সত্যজিৎ রায়। যদি ‘চোখ’ ছবিটির ওপর বিশেষ নজর রাখা হয়, তাহলেই বোঝা যায় ১৯৮০ সালে সত্যজিৎ রায় সমাপ্ত করা ‘সদগতি’ ছবির যে গ্রোথ, তাকেই রাজনৈতিক উচ্চাশা দিয়ে চোখ-এ পরিণত করেন উৎপলেন্দু। ‘সদগতি’-তে ওম পুরী ও স্মিতা পাতিলের যা অভিনয়, তা প্রায় হুবহু শ্রীলা মজুমদার এবং ওম পুরী অনুকরণ করেন ‘চোখ’-এ। উৎপলেন্দু সত্যজিৎ রায়ের সংগীত নিয়ে ১৯৮৪ সালে যে তথ্যচিত্রটি করেন, তাও সত্যজিৎ রায়ের প্রতি একরকম অর্ঘ্য। আমাদের মনে করতেই হবে, তিনি তাঁর আগের বছর ১৯৮৩ সালে দেবব্রত বিশ্বাসের সংগীত নিয়েও তথ্যচিত্রের কথা। তবে দুঃখের কথা হল,জনপরিসরে উৎপলেন্দুর এই ছবিগুলো বিশেষ পরিচিতি পায়নি। বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন তুলে ধরার শেষ স্রষ্টা বিদায় নেন কিংবদন্তি মৃণাল সেনের শতবর্ষপূর্তির বছরেই। যা এক অপরিসীম শূন্যতা তৈরি করে গেল বাংলা ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্যে।