গান্ধীজি যখন অনশনে বসেছিলেন তখন তাঁকে যিনি গান শুনিয়েছিলেন তিনি অরুন্ধতী দেবী। গান দুটি ছিল ‘যদি তোর ডাক শুনে’ আর ‘আমায় ক্ষম হে ক্ষম’। গান্ধীজির মৃত্যুর পরে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি আকাশবাণীতে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন তাঁর আরও এক প্রিয় মানুষ তাঁরই গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গানের মধ্যে দিয়ে। কারণ, মাত্র বারো বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে তাঁর গাওয়া গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! নাচ, গানের পাশাপাশি ছবি আঁকার হাতও ছিল চমৎকার। এরপর শুরু নাচ-গান-আঁকার তালিম। এক সময় ঠিক করেছিলেন পেশাদার আঁকিয়েই হবেন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে শেষমেশ এসে পড়েন চলচ্চিত্র জগতে।
তাঁর চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের ঘটনাতেও জড়িয়ে রয়েছে এক কাহিনী। ১৯৫২ সালে নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত নতুন ছবির কথা ভাবেন পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। পরিচালকের ইচ্ছে এই ছবিতে নতুন অর্থাৎ নবাগত এবং নবাগতা কোনও নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে ছবি করবেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে খোঁজ মেলে এক নতুন জুটির। নেওয়া হল পরীক্ষা। পাশ করে ছবিতে অভিনয় করলেন বসন্ত চৌধুরী এবং অরুন্ধতী দেবী। আর প্রথম ছবি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’-নিয়ে এল সাফল্য। শুধু বাংলাই নয়, দুই নবাগত শিল্পীকে নিয়ে করা এই ছবির বাংলা এবং হিন্দি এই দুই সংস্করণই দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। এইভাবেই দর্শকদের মনে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নেন অরুন্ধতী দেবী। বাংলা চলচ্চিত্র জগত পেল এক নতুন এবং অনন্যসাধারণ অভিনেত্রীকে, যাঁর মধ্যে রূপের সঙ্গে ছিল আভিজাত্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, অরুন্ধতীদেবী বৈচিত্র্যময় চরিত্রের মধ্যে বিচরণ করেছেন দীর্ঘ অভিনয় জীবনে। ‘জতুগৃহ’র সাধারণ ঘরণি মাধুরীর পাশাপাশি অসিত সেনের ‘চলাচল’ বা নির্মল দে’র ‘দুজনায়’ ছবিতেও একইরকম সপ্রতিভ তিনি। অসাধারণ ‘ঝিন্দের বন্দি’র রাণী কস্তুরীর ভূমিকাতেও। আবার ‘ছেলে কার’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ বা ‘শশীবাবুর সংসার’-এর মতো ছবিতে হাসির দৃশ্যেও সমানভাবে সাবলীল। ১৯৬২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিজয় বসুর ‘ভগিনী নিবেদিতা’ চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের তরফে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান অরুন্ধতী। প্রতিটা চরিত্রেই তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এছাড়াও ওঁর ছবির তালিকায় রয়েছে, ‘চলাচল’, ‘পঞ্চতপা’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘কালামাটি’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘শশীবাবুর সংসার’, ‘ন্যায়দণ্ড’, ‘ছেলে কার’, ‘বিচারক’, ‘জন্মান্তর’, ‘টাকা আনা পাই’ -এর মতো বেশকিছু সিনেমা।
কথাসাহিত্যিক বনফুলের গল্প অবলম্বনে নির্মিত অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কেরিয়ারের প্রথম ছবি হল ‘কিছুক্ষণ’। অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়ের কেরিয়ারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি হল পরিচালক-অভিনেতা সুশীল মজুমদারের নির্মিত ‘পুষ্পধনু’। চলচ্চিত্র নির্মাতা তপন সিংহ বলেছিলেন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে অরুন্ধতীর নির্বাক অভিনয় সকল দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। ছবিতে ওঁর নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে অসংখ্য সংলাপ। আর জতুগৃহ’-তে উত্তমকুমারের বিপরীতে তাঁর অভিজাত্যপূর্ণ অভিনয়ের সঙ্গে মিশে ছিল রোম্যান্টিসিজম। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ‘বিচারক’ ছবির শেষ অংশে তাঁর চরিত্রায়নে ফুটে উঠেছিল এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। ‘শশীবাবুর সংসার’ ছবির পার্শ্বচরিত্রে তাঁর অভিনয়ের বলিষ্ঠতা এক মাত্রা যোগ করেছিল ছবির চিত্রনাট্যে।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়, ওই সময়ে অরুন্ধতী মুখোপাধ্য়ায়ের মতো ওরকম সুন্দরী নায়িকা আর কেউ ছিলেন কিনা তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। তার ওপর দুর্দান্ত অভিনয়-প্রতিভা। সব মিলিয়ে দর্শকের কাছে অরুন্ধতী দেবীর আকর্ষণ ছিল ভয়ানক। এরপর দু’বছরের বিরতি। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি, চিত্ত বসু পরিচালিত ‘নদ ও নদী’ এবং ওই বছরেরই শেষে মুক্তি পায় ভোলানাথ মিত্র পরিচালিত ‘বকুল’। ‘বকুল’ ছবিটিতে অরুন্ধতী দেবীর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার। ছবির জগতে তখনও পাকাপাকিভাবে পা রাখার জায়গা তৈরি হয়নি তাঁর, তবুও অরুন্ধতীর অভিনয় আর ক্যারিশ্মায় সেদিন চাপা পড়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং মহানায়কও। পরে উত্তমকুমার নিজমুখে স্বীকার করেন, ‘ওঁর সঙ্গে যখন অভিনয় করতাম, তখন খুবই সতর্ক থাকতাম। আমার নিজের অভিনয়ের মধ্যে ইনটেলেকচুয়াল ফ্লেভার মিশিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। না হলে মার খেয়ে যাবার ভয় ছিল।’ তপন সিংহের ‘জতুগৃহ’ বা প্রভাত মুখোপাধ্য়ায়ের ‘বিচারক’, পরবর্তীকালেও দু’জনের অভিনীত ছবিগুলিতে উত্তম-অরুন্ধতীর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলেছিল সমানে-সমানে।
অরুন্ধতী দেবী ছকভাঙা অভিনয় শিল্পী তো ছিলেনই, পাশাপাশি ছবি পরিচালনা, সুরারোপ থেকে চিত্রনাট্য-সব মিলিয়ে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কথাসাহিত্যিক বিমল করের ‘খড়কুটো’ উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬৭ সালে অরুন্ধতী দেবী নির্মাণ করেন বিয়োগান্তক রোম্যান্টিক ছবি ‘ছুটি’। এই ছবির জন্য তিনি নির্বাচন করেছিলেন এক নতুন জুটিকে। মৃণাল মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিনী মালিয়ার অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছিল একাধিক ‘বিএফজে’ পুরস্কারও। সেরা পরিচালকের পুরস্কারও জিতে নিয়েছিলেন অরুন্ধতী দেবী। ছবিটাও তো সুপার-ডুপার হিট হয়েছিল। পরের ছবি রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র’। এই ছবিটি তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও সেটি যে অত্যন্ত উচ্চমানের হয়েছিল, সে কথা অনায়াসেই বলা যায়। দুটি ছবিরই সংগীত পরিচালনা করেছিলেন অরুন্ধতী দেবী স্বয়ং। আরও পরে পরিচালনা করেন ছোটদের ছবি লীলা মজুমদারের কাহিনী অবলম্বনে ‘পদিপিসীর বর্মি বাক্স’। এই ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেন ছায়াদেবী। অরুন্ধতী দেবীর চতুর্থ পরিচালিত ছবি ‘দীপার প্রেম’। এটি তেমনভাবে বক্স অফিস পায়নি। এখানে একটা কথা বলতেই হয়, সিনেমা পরিচালনার মতো দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রেক্ষিতে তাঁকে নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা হওয়া উচিত তা হয়ে ওঠেনি আজও।
অরুন্ধতী দেবী সম্পর্কে আরও একটা কথা না বললেই নয়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান রেকর্ড করেছিলেন অরুন্ধতী দেবী। তবে কখনও গেয়ে পারিশ্রমিক নিতে চাইতেন না, এমনকী আকাশবাণী দিলেও নয়। কারণ, রবীন্দ্রনাথের গান ছিল তাঁর কাছে ছিল পবিত্র এক সাধনার বিষয়।