‘একম মমতা, দ্বিতীয় নাস্তি’

সনাতন হিন্দু ধর্মে একটা কথা আছে। ‘একম ব্রহ্ম দ্বিতীয় নাস্তি’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বর’ হলেন ‘এক’ ও ‘অদ্বিতীয়’ । আবার ‘একম অদ্বিতীয়ম’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বর অদ্বিতীয়’। ঠিক এমনই এক ছবি ধরা পড়ল ক’দিন আগে দলের তৃণমূলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে।  সেদিনের বৈঠকে ‘তিনি’ প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তৃণমূলে ক্ষমতার কেন্দ্র একটাই। দুটো নয়। আমি দলের চেয়ারপার্সন, আমার কথাই শেষ কথা। আর এ বার্তা দিয়েছেন সেই ‘তিনি’- অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সূত্রের খবর, তাৎপর্যভাবে আরও দুটি কথা বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলে ছাত্র ও যুব সংগঠন অনেক দিন ধরে দেখছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ছাত্র ও যুব সংগঠন আমি সাজিয়ে দেব।’ তৃণমূলে অভিষেকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত নেতা নারায়ণ গোস্বামীকেও এদিন ধমক দিয়েছেন দিদি। তাঁকে বলেছেন, তোমাকে আর এদিক ওদিক যেতে হবে না। নিজের এলাকায় নজর দাও। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ রসায়ন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে কদিন আগে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছিলেন নারায়ণ।

নারয়ণ এমন কথা বললেও বিষয়টি এমন নয় যে, তৃণমূলের রাশ থাকত অন্য কারও হাতে। তবে দলের অন্দরেই দানা বেঁধেছিল একাধিক গুঞ্জন। নবীন-প্রবীণ বিতর্কে অভিষেক-মমতার মধ্যে দূরত্ব নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা জল্পনা। সম্ভবত সেই কারণেই দলের নেতৃত্বের চাবিকাঠি যে তিনিই তা ফের স্পষ্ট করেন তৃণমূল সুপ্রিমো। একইসঙ্গে ছাত্র-যুব সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কথাও জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তবে বাংলার এখন যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে তা আপাত ভাবে শাসকদলের কাছে একটা বিরোধী শূন্য অবস্থা। বিশেষ করে সম্প্রতি উপনির্বাচনের পর তেমনই যেন একটা আবহ। এই অবস্থায় তৃণমূলের অনেক নেতা মন্ত্রীর মধ্যে ‘যেমন খুশি সাজো’-র মতো এক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই আলটপকা অনেক কথা বলে দিচ্ছেন। তাতে তৈরি হচ্ছে অযথা বিতর্কের।

অতীতে বিভিন্ন ইস্যুতে দলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদরা বেফাঁস মন্তব্য করে বিতর্কও যে বাড়াচ্ছেন না তাও নয়। আর সেই কারণেই এবার কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমোর।দলীয় শৃঙ্খলা সবাইকে মানতে হবে। একইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমোর সাফ বার্তা, মেপে কথা বলতে হবে। যা ইচ্ছা যখন ইচ্ছা মিডিয়ার সামনে মুখ খুললে চলবে না। বেচাল দেখলে দল ব্যবস্থা নেবে। শুধু বার্তা দিলেন বললেও বোধহয় সবটুকু বলা হয় না, সেদিনের বৈঠকে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীকে এ জন্য একটু বকুনিও খেতে হয়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন এও বলেন, কারও কোনও অসুবিধা থাকলে তাঁরা যেন ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস বা দেবাশিস কুমারকে জানান। দিদির এ কথাও অনেকে অর্থবহ বলে মনে করছেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, কদিন আগে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কাজকর্ম নিয়ে যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তা যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এখন বোঝা যাচ্ছে। কল্যাণের সেদিনের কথা আর মুখ্যমন্ত্রীর এদিনের বক্তব্যের মধ্যে কোথাও যেন একটা সুতো আছে। অর্থাৎ এক সুতোতেই তা গাঁথা।

এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলতেই হয়, ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলে একটা ঝাঁকুনি দিতে চাইছিলেন। লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর পরই সেই প্রক্রিয়া শুরুও করেন তিনি। কিন্তু এরই মধ্যে আরজি কর কাণ্ড তার এই প্রক্রিয়ায় এক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সম্প্রতি উপনির্বাচনের ফলাফলে আরজি কর পর্ব আড়াল হয়ে যাওয়ার পর ফের সেই ঝাঁকুনির প্রক্রিয়া ফের শুরু করেন তৃণমূল সুপ্রিমো। আর সেই কারণেই বিধানসভার নওশাদ আলি কক্ষে পরিষদীয় দলের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী দলের বিধায়কদের এও নির্দেশ দেন , ‘ছাব্বিশের ভোট আসছে। মানুষের ঘরে ঘরে যান। অভাব-অভিযোগ, সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিন। আরও শৃঙ্খলাপরায়ণ হোন।’

তবে এই ঘটনার পর ‘সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’, মমতাই দায়িত্ব নিচ্ছেন দলের। বিরাট খবর! তবে পাশাপাশি তৈরি হল বড় প্রশ্নচিহ্নও, এর মানে কী? এতদিন কার হাতে ছিল দলের ভার? তাহলে কে বলতেন শেষ কথাটা? যে কোনও নির্বাচনের সময়ে প্রার্থী তালিকাতে কার সিলমোহর পড়ার পরেই তা ঘোষণা করা হত? কে এসবের দায়িত্বে ছিলেন?

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়, পৃথিবীতে একটা, আর একটা রাজনৈতিক দল কেউ দেখাতে পারবেন না যে দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা বা নেত্রী নিজের দলের নির্বাচনী চিহ্ন এঁকেছেন, দলের পতাকা তৈরি করেছেন আর তারপরে তা ছড়িয়ে গেছে লক্ষ কোটি মানুষের কাছে। এর এক এবং অদ্বিতীয় উদাহরণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সব্বার চোখে তৃণমূল দলটা এতটাই তাঁর, একটা ইনসেপারেবল এনটিটি, অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব। তাঁকে আর তৃণমূল দলকে আলাদা করার ক্ষমতা বোধহয় স্বয়ং ইশ্বরেরও নেই। এই প্রসঙ্গে একটু অতীতে ফিরে যাওয়া যাক। সেই দিনটার কথা স্মরণ করা যাক যেদিন নতুন দল তৈরি হয়েছে। সামনেই নির্বাচন, মমতা ঘাসফুল এঁকে ফেলেছেন। সোমেন মিত্র উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন। তখন কোনও একজন সাংবাদিক তাঁকে ওই নির্বাচনী প্রতীক দেখিয়েছিলেন। সোমেন মিত্র সেই নেতা, যাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করেই দল ছেড়েছিলেন মমতা। তৈরি করেছিলেন নতুন দল। সেই সোমেন মিত্র সেদিন বলেছিলেন এমন উদ্ভট প্রতীক চিহ্ন আর দেখিনি। হেসেওছিলেন একচোট। ডেসটিনি কাকে বলে, সেই সোমেন মিত্র ক’বছর পরেই ওই জোড়াফুলে ঘাসফুল চিহ্ন নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ডায়মন্ড হারবার থেকে জিতে দিল্লি গিয়েছিলেন। হাত শিবিরে অপমানিত সোমেন মিত্রকেও দলে ঠাঁই দিয়েছিলেন মমতা। তাঁর পাশে থাকা দুর্দিনের সঙ্গীরা একটা কথাও বলেননি। বলেও কোনও লাভ হত না, কারণ দলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ একটিই। আর যাঁরা মমতাকে চেনেন, তাঁরা জানেন উনি প্রতিটা খেলা খেলেন একেবারে স্ট্রেট ব্যাটে। কোনও ফালতু কায়দাবাজি নেই। উনি যা বলতে চান সেই মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার ভাবেই তা দেন দলের মধ্যে। আর তা প্রতিধ্বনিত হয় বঙ্গ জুড়ে। এবার এটাও শুনতে হচ্ছে এহেন নেত্রী নাকি দলের দায়িত্ব নিলেন! ফলে প্রশ্ন তো উঠবেই, খুব সাধারণ প্রশ্ন, দলটা ছিল কার কাছে? তিনি কি কোথাও একদিনের জন্যও দলকে কারও জিম্মাতে ছেড়েছিলেন? তাহলে এমন বোকা বোকা হেডিং, এমন বোকা বোকা ব্রেকিং নিউজ আসছে কেন? উনিই বলবেন শেষ কথা, মমতাই দলের দায়িত্বে, সেটা জানিয়ে দিলেন। কাকে আর কার হাত থেকে কবে তিনি এই দায়িত্ব নিলেন এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয় কি?

এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, দলের একটা হাফ কি কোয়ার্টার সিদ্ধান্তও তাঁর অসম্মতিতে নেওয়া হয়নি কোনও দিন। সেসব নিয়ে একটা কথাও কিন্তু লেখা হচ্ছে না, কেবল একটা ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে, যেন দলের মধ্যে মারকাটারি চলছে। দল যেন দুই ভাগ হওয়ার মুখে। একবারের জন্যও যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের দায়িত্ব অন্য কারও উপরে ছেড়েছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও কেউ দিতে পারেননি। কারণ, কারও একবারের জন্যও মনে হয়নি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সায় ছাড়া তৃণমূল দলে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। সঙ্গে এটাও ঘুণাক্ষরে কারও মনে হয়নি আপনাদের কি একবারের জন্য মনে হয় যে তৃণমূল দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে কথা বলার কেউ আছে।

এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা একেবারে এককাট্টা বললে ভুল হবে না। তাঁরা জানাচ্ছেন, অনেক আঞ্চলিক দল আছে যা একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা, অভিনেতা, বা কোনও দলের বড় নেতা তৈরি করেছেন, কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের তৃণমূলের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হয়ে যাবে। এখানে উনিই এক এবং অদ্বিতীয়। অতি বোকা বা মূর্খও এই দলে থেকে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে যাবে না। এমনকী শুভেন্দু দলের মধ্যে থাকাকালীন একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেননি। অনর্গল বাজে বকতে পারা রুদ্রনীলও নয়। পিছনে বিজেপির খুঁটিতে ল্যাজটা বাঁধার পরেই মমতার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পেরেছেন। এ দলের পতাকা থেকে দলের নিয়মকানুন সব কিছুর শেষ কথা ওই এক মমতা। কাজেই বিগ্রহকে চ্যালেঞ্জ করে যেমন মন্দিরের পূজারী হওয়া যায় না, তেমনই তৃণমূল দলে থেকে মমতার বিরোধিতা অসম্ভব। যাঁরা এই খবর ছাপছেন, বানাচ্ছেন, গেলাচ্ছেন তাঁদের আসলে ওই ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’ গোছের একটা ব্যাপার। কাজ নেই তাই একটা ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা চালানো।

এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা না বললেই নয়। ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’ বলে এই আপ্তবাক্যটি অনেকেই ব্যবহার করেন। তবে এর অর্থ  অনেকেই জানেন না। এই আপ্তবাক্যকে উপলব্ধি করতে গ্রামের এক গৃহস্থ বাড়ির ছবি সবার আগে আপনাকে কল্পনা করতে হবে। যেখানে মাঠের ধান পল দিয়ে খামারে রাখা, ক’দিন পরে ঝাড়া হবে, গরুটা বিইয়েছে তাও একমাস হল, দুধ হচ্ছে ৫-৬ লিটার, খেতে লাউ, শশা, পালং শাক, দেখলে মন ভরে যায়। পুকুরে খ্যাপলা ফেললেই এবেলার খাবার মতো মাছ উঠছে, সেও তো তুলছে ছোট ছেলে। হাড়ির সব কাজ সারছেন ঘরের বৌয়েরাই। ফলে গিন্নিমা অর্থাৎ শাশুড়ি মাতার কাজ নেই বললেই হয়। কিন্তু তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন তাও হয় না। পরিবার থেকে শুরু করে পড়শিদের মধ্যে কথা হবে অনেক। অতএব, চাড্ডি ধান এনে খই ভাজতে বসেন তিনি। যা দেখে ঘরের কর্তারা দেখেন তিনি বসে নেই, কাজ করছেন। এই হল এই আপ্তবাক্য তৈরির সূত্র। ঠিক তেমনই হল আমাদের মিডিয়া, সংবাদমাধ্যমের। খবর নেই, কিন্তু সেনসেশনাল নিউজ দিতে হবে। ক্রমাগত মানুষের উত্তেজনাকে জাগিয়ে রাখার পাশাপাশি তা চাগিয়েও তুলতে হবে প্রতিমুহূর্তে। তার জন্য় কেবল কাজিয়া যথেষ্ট নয়। টিআরপির আর রিডার্স সংখ্যা বাড়াতে কিছু তো করতে হবে, অন্তত করার ভান করতেই হবে। আমরা সাংবাদিককুল এ ব্যাপারে প্রত্য়েকেই অবগত। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। তাই ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 4 =