এজবাস্টনে জয়ের দীপ জ্বালালেন আকাশ, মহানায়ক গিল

দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডকে ৩৩৬ রানে হারিয়ে সিরিজে সমতা ফেরাল ভারত। পাঁচ ম্যাচের সিরিজের ফলাফল এখন  ১। যে এজবাস্টনে ভারত কোনওদিন জিততে পারেনি, সেই মাঠেই শুবমানের টিম নিয়ে এল জয়। একইসঙ্গে অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদও পেলেন শুভমান। 

ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে অর্থাত্ ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ৬০৮ রানের টার্গেট দিয়েছিল ভারত। চতুর্থ ইনিংসের জন্য পাহাড় প্রমাণ রান বলতেই হবে। এদিকে আকাশ দীপ আর মহম্মদ সিরাজের গতিতে দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথমেই ভাঙন ধরে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে। চতুর্থ দিনের শেষে রান দাঁড়ায় ৩ উইকেটে ৭২। পঞ্চম ও শেষ দিনে ৫৩৬ রান করলে জিতবে ইংল্যান্ড, এই অবস্থায় ব্যাট করতে নেমে বেন স্টোকসরা থেমে গেলেন ২৭১রানে।

পঞ্চম দিনের শুরুতেই আকাশদীপ ফের ধাক্কা দেন ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে। পোপ (২৪) ও হ্যারি ব্রুককে (২৩) দ্রুত ফেরান বাংলার পেসার। ৮৩ রানে পাঁচ উইকেট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। এর পরে ৭০ রানের পার্টনারশিপ গড়েন স্টোকস ও জ্যামি স্মিথ। লাঞ্চের ঠিক আগে  স্টোকসকে এলবিডব্লিউ করে এই পার্টনারশিপ ভাঙেন ওয়াশিংটন সুন্দর। লাঞ্চের সময় ইংল্যান্ডের রান ৬ উইকেটে ১৫৩। 

ততক্ষণে জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করেছে ভারত। স্মিথ ও ক্রিস ওকস ৪৬ রান জোড়েন। প্রসিদ্ধ কৃষ্ণার বিষাক্ত ডেলিভারি বুঝতে না পেরে সিরাজের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ওকস ()তবে এই পার্টনারশিপের সিংহভাগ রান করেন স্মিথ। এরপর ৮৮ রানে স্মিথকে ফেরান আকাশ দীপ।এরপর জাদেজার বলে জশ টংয়ের ক্যাচ অবিশ্বাস্য ভাবে ঝাঁপিয়ে ধরেন সিরাজ।বাকিটা ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা। প্রথম ইনিংসে চারটির পরে দ্বিতীয় ইনিংসে ৬টি উইকেট তুলে নেন আকাশ দীপ।

কে বলবে জশপ্রীত বুমরাহ এই টেস্টে নামেননি। বিশ্বের সেরা বোলারকে বাইরে রেখে টেস্ট ম্যাচ জিতে নিল ভারত। আকাশদীপের জন্যই বুমরাহর অভাব টের পেল না ভারত। অন্যদিকে হেডিংলে টেস্টে জয়ের পর ইংল্যান্ড শিবিরে একটা আত্মবিশ্বাস এসে গিয়েছিল। সেটা তাদের কোচ থেকে শুরু করে প্লেয়ার সকলের কথাতেই ফুটে আসছিল। একদিকে বাজবল, অন্যদিকে হাইওয়ে পিচ এই দুই শক্তি নিয়ে তারা খেলতে নেমেছিল এই টেস্টে। কিন্তু জশপ্রীত বুমরা বাদে যে দল তৈরি সেটা বুঝতে পারেননি বেন স্টোকসরা। বুমরা না থাকায় কোন বোলার ২০ উইকেট নেবেন সেই প্রশ্ন ছিল। সেটার উত্তর মিলল। বাংলার পেসার আকাশ দীপ ইংল্যান্ডের কাছে ছিল সিলেবাসের বাইরে। তাই তাঁর র পেস ও হাল্কা টার্ন বুঝতে পারলেন না জো রুটের মতো পোড়খাওয়া ব্যাটারও।

আকাশ দীপের সঙ্গ দিয়েছেন মহম্মদ সিরাজ। আকাশ দীপকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছেন সিরাজ। তবে মর্নি মরকেল সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছেন, আকাশ দীপের জন্য সিরাজ ব্যাকফুটে। ইংল্যান্ডকে প্রথম ইনিংসেই ব্যাক গিয়ারে ঠেলে দেওয়ার প্রধান কারিগর টিম ইন্ডিয়ার মিঞাঁ ভাই সিরাজই।

বোলারদের পাশাপাশি এই ম্যাচটা প্রধানত ছিল ব্যাটারদের। বাজ়বলের জমানায়, ইংল্যান্ড বেধড়ক্কা পিটিয়ে রান তোলার দিকে ঝোঁকে। স্টুয়ার্ট ব্রড, জিমি অ্যান্ডারসনদের পর যেটা আরও বেড়েছে। এ বারও সেটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা। কিন্তু সেটাতে জল ঢেলে দেন শুবমান গিল। প্রথম ইনিংসে ২৬৯ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি করেন ১৬১ রান। তাঁকে সঙ্গত দিলেন কেএল রাহুল, ঋষভ পন্থ, রবীন্দ্র জাডেজা।

এজবাস্টনে জিতে একই সঙ্গে টিম ইন্ডিয়া দল হিসেবে গড়েছে একাধিক বিশ্বরেকর্ড।এই প্রথম বার্মিংহামের এজবাস্টনে টেস্ট ম্যাচ জয়ের স্বাদ পেল ভারতীয় দল। ১৯৬৭ সাল থেকে এই মাঠে ম্যাচ খেললেও আজ পর্যন্ত জিততে পারেনি ভারত। ২০২৫ সালে তৈরি হল নতুন ইতিহাস।বার্মিংহাম টেস্ট জয় বিদেশের মাটিতে সবথেকে বড় টেস্ট জয়। এর আগে ২০১৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৩১৮ রানে ম্যাচ জিতেছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। বার্মিংহামে জিতল ৩৩৬ রানে।দেশবিদেশ মিলিয়ে ভারতের রানের নিরিখে সবথেকে বড় টেস্ট জয়ের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্ট জয়। ঘরের মাঠে ৪৩৪ রানে ম্যাচ জয় ভারতের সবথেকে বড় জয়। বার্মিংহাম জায়গা করে নিল চতুর্থ নম্বরে। ইংল্যান্ডের মাটিতে এর আগে এত বড় ব্যবধানে টেস্ট ম্যাচ জিততে পারেনি কোনও ভারতীয় দল। বার্মিংহাম টেস্ট জয় সেই নিরিখেও জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

ইংল্যান্ডে এটিই ভারতের ১০ম টেস্ট জয়। গিল হলেন সপ্তম ভারতীয় অধিনায়ক যিনি ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জয়ের স্বাদ পেলেন। তার আগে অজিত ওয়াদেকর, কপিল দেব, সৌরভ গাঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল দ্রাবিড়, এমএস ধোনি এবং বিরাট কোহলি এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। কোহলি সবথেকে বেশি ৩টি টেস্ট জিতেছেন।

ইংল্যান্ড সিরিজ়ের আগে টেস্ট থেকে অবসর নেন রোহিত শর্মা। এর পর বিরাট কোহলিও একই পথে হাঁটেন। দুই তারকার অবসরের পর প্রশ্ন ছিল, দলের হাল ধরবেন কে এটা নিয়ে শুরু হয় জল্পনা। বিশেষ করে অধিনায়ক কে হবেন তা নিয়ে তৈরি হয় প্রশ্নচিহ্ন। এই সময়ে দলের দায়িত্ব দেওয়া হয় শুবমান গিলকে। ২৫ বছরের গিল কতটা চাপ নিতে পারবেন সেই প্রশ্নটা ছিল বড়। প্রথমে হেডিংলে টেস্টে গিল দেখালেন তিনি চাপ নিতেই নয়, চাপ দিতেও তৈরি। হেডিংলেতে লোয়ার অর্ডারের ব্যর্থতায় জেতা হয়নি। তবে লড়াই ছিল। এবার সেই লড়াইটাকে কাজে লাগিয়ে জেতা হলো বার্মিংহাম।

তবে রবিবার সকাল থেকে ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখ ছিল ভার। কারণ,  শনিবার রাতে বৃষ্টি হয় বার্মিংহামে।  এরপর রবিবার সকালেও বৃষ্টি। আকাশে তখনও কালো মেঘের আনাগোনা। আরও বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সবার মনে তখন একটাই চিন্তা, তবে কি শেষমেশ বরুণদেব ভারতের জয়ের আশায় দল ঢেলে দেবেনকারণ, চতুর্থ দিনের শেষে অ্যাডভান্টেজে ভারত। পঞ্চমদিনে জিততে হলে ইংল্যান্ডকে করতে হবে আরও ৫৩৬ রান।  রবিবার এজবাস্টনে বৃষ্টির সম্ভাবনা আগে থেকেই ছিল। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনেও ভারতীয় দল ডিক্লেয়ার করতে কেন দেরি করল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ভারতীয় দলের বোলিং কোচ জানান, তাঁরা নিরাপদ জায়গায় থাকতে চেয়েছিলেন। আর আবহাওয়ার গতিবিধি তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাই এটা নিয়ে বিশেষ ভাবছেন না। এরপরই ভারতীয় সময় বিকেল পাঁচটা দশ মিনিটে খেলা শুরু হয়। বৃষ্টির জন্য নির্ধারিত সময়ে খেলা শুরু না হওয়ায় ১০ ওভার কেটে নেওয়া হয়। ৯০ ওভারের ম্যাচ হয়ে যায় ৮০ ওভারের।

দ্বিতীয় টেস্টে ব্যাট হাতে  মুগ্ধ করেছেন শুবমান। বল হাতে  আকাশদীপ ও মহম্মদ সিরাজ। তবে আলাদা করে প্রশংসা করতেই হবে শুবমান গিলের। প্রথম ইনিংসে ২৬৯ রানের পরে দ্বিতীয় ইনিংসেও ১৬১। এছড়াও নজরকাড়া ফিল্ডিংয়ের পাশাপাশি দুর্দান্ত অধিনায়ত্ব। সব মিলিয়ে ভারতীয় অধিনায়কই ম্যাচের মহানায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen + four =