রবিবারই সোশাল মিডিয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন, দিল্লি পুলিশ মালদার চাঁচোলের বাসিন্দা এক পরিযায়ী শ্রমিকের দেড়বছরের সন্তানকে মায়ের কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরপর শিশুটির মাকে থানায় নিয়ে গিয়ে একদিন আটকেও রাখা হয়। আর তাঁকে ছাড়ার জন্য দিল্লি পুলিশ ২৫ হাজার টাকা নিয়েছে বলেও অভিযোগ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই প্রতিবাদী পোস্ট এক্স হ্যান্ডেলে প্রচারিত হওয়ার পর, ফের তৎপর দিল্লি পুলিশ ৷ অভিযোগ উঠেছে, রবিবার রাতে আবারও পরিযায়ী শ্রমিক মুক্তার খান, তাঁর স্ত্রী সাজেনুর পারভিন ও তাঁদের দুই সন্তান এবং মুক্তারের মাকে থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ৷ রাতভর তাঁদের খেতে দেওয়া হয়নি৷ এমনটাই অভিযোগ, ধৃত পরিযায়ী শ্রমিকের বোন মুক্তারি খাতুন এবং চাঁচোলের বিধায়ক নীহাররঞ্জন ঘোষের৷ সোমবার দুপুর পর্যন্ত ছাড়া পাননি পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবার। এই ঘটনায় মুক্তারি খাতুন চাইছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁর বাবা–মা এবং দাদা–বউদি দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরে আসুক। কারণ, ভিনরাজ্যে তাঁরা বিপন্মুক্ত নন ৷ শুধু তিনি নন, প্রশাসনও মুক্তার খান ও তাঁর পরিবারকে দিল্লি থেকে তড়িঘড়ি জেলায় ফিরিয়ে আনতে চাইছে ৷ এদিকে এই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় রাজ্য, এমনকি দেশও ৷
এদিকে সূত্রে খবর, চাঁচোল থানার হাজতপুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তার খান ৷ তিনি পেশায় পরিযায়ী শ্রমিক ৷ দীর্ঘদিন ধরেই দিল্লিতে কাজ করছেন ৷ সেখানে তিনি সরকারি শৌচালয় সাফাইয়ের কাজ করেন ৷ তাঁর স্ত্রী সাজেনুর পারভিনও স্বামীর সঙ্গে ওই রাজ্যে থাকেন ৷ তাঁরা দিল্লির গীতা কলোনি এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন৷ তাঁদের এক ছেলে এবং দেড় বছরের কন্যাসন্তান রয়েছে ৷ শুধু মুক্তার বা সাজেনুর নন, মুক্তারের বাবা–মা’ও কর্মসূত্রে দিল্লিনিবাসী ৷ তাঁরাও পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন৷ শুক্রবার দিল্লি পুলিশ তাঁদের ভাড়া বাড়িতে হানা দেয় ৷ তখন মুক্তার বাড়িতে ছিলেন না, কাজে গিয়েছিলেন ৷ অভিযোগ, সেই সময় পুলিশকর্মীরা সাজেনুরকে জোর করে থানায় নিয়ে যান৷ ওই সময় সাজেনুরের কোলে ছিল, তাঁর মেয়ে ৷ অভিযোগ, সেই সময় এক পুলিশকর্মী তাঁর শিশুকন্যাকে কোল থেকে কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দেন৷ এই ঘটনায় বাচ্চাটির মাথা ও কানে আঘাত লাগে ৷ রক্ত বেরোতে শুরু করে তার ৷ কিন্তু, সেদিকে কোনও গুরুত্ব না–দিয়ে দিল্লি পুলিশ সাজেনুরকে থানায় নিয়ে যায় বলে অভিযোগ ৷ অভিযোগ, সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশি সন্দেহে তাঁকে ধরা হয়েছে৷ ২৫ হাজার টাকা দিলে সাজেনুরকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাটি জানতে পারেন মুক্তার ৷ তিনি থানায় গিয়ে অনুনয়–বিনয় করেন৷ কিন্তু, তাতে কোনও কাজ না–হওয়ায়, মুক্তার শেষ পর্যন্ত পুলিশের দাবি মেনে ২৫ হাজার টাকা তাঁদের হাতে তুলে দেন ৷ তারপরেই সাজেনুরকে ছাড়ে দিল্লি পুলিশ ৷
ঘটনাটি জানতে পেরে রবিবার রাতেই মুক্তারের মালদার বাড়িতে যান চাঁচল থানার আইসি৷ ওই পুলিশ আধিকারিক বেশ কিছু সময় তাঁর সঙ্গে কথা বলেন৷ পুলিশ আধিকারিককে জানান সমগ্র ঘটনাও। ঘটনাটি জানতে পেরেই মুক্তার খানের পরিবারকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন চাঁচোল ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ জহুর আহমেদ৷ সঙ্গে এও জানান, ‘ওরা আমাকে জানিয়েছে, বাংলাভাষী বলেই পুলিশ ওদের ধরে নিয়ে গিয়েছে ৷ অথচ ওদের কাছে আধার ও ভোটার কার্ড–সহ ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের অনেক নথি ছিল৷ কিন্তু, পুলিশের এক কথা, ওরা নাকি বাংলাদেশি ৷ পরবর্তীতে মুক্তার তাঁর এক দিল্লিবাসী বন্ধুকে নিয়ে থানায় যান ৷ থানায় গেলে সেখানকার পুলিশ মুক্তারকে জানায়, ২৫ হাজার টাকা দিলে সাজেনুরকে ছাড়া হবে৷’ স্ত্রীকে থানা থেকে বের করে আনার পর তাঁকে নিয়ে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে যাওয়া হলে হাসপাতালের এক চিকিৎসক মুক্তারকে সাফ জানিয়ে দেন, তাঁরা নাকি বাংলাদেশি ৷ কোনও বাংলাদেশিকে তাঁরা ভর্তি নেবেন না ৷ এরপর একটি প্রেসক্রিপশনে শুধু ওষুধ লিখে দেওয়া হয়। বাচ্চাটির কপাল আর কানে ভালো চোট লেগেছে ৷ তবে, এখন সে খানিকটা সুস্থ রয়েছে৷’ একইসঙ্গে মুক্তার এও জানান, গোটা বিষয়টি চাঁচল ১ নম্বর ব্লকের বিডিও–কে জানাই ৷ রাজ্যসভার সাংসদ মৌসম নুরকেও জানাই ৷ সাংসদ আমাকে দ্রুত সমস্ত নথিপত্র পাঠাতে বলেন ৷ আমি তাঁকে সমস্ত নথি পাঠিয়ে দিই ৷ এরপর সাংসদ বিষয়টি দিল্লিতে জানান ৷ তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয় ৷’
এই ঘটনায় পঞ্চায়েত সমিতির খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ বলেন, ‘গোটা ঘটনা জানতে পেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ করেন। মুক্তার–সাজেনুর এখন তাঁদের কোয়ার্টারে রয়েছেন ৷ রবিবার সকাল থেকে সেখানকার পুলিশ বারবার তাঁদের ফোন করছে ৷ তাঁদের থানায় ডেকে পাঠাচ্ছে ৷ আমি তাঁদের জানিয়েছি, তাঁরা যেন কিছুতেই থানায় না–যান ৷ তাঁরা যেন বাড়ি ফিরে আসেন ৷ মুক্তাররা বাড়ি ফিরে এলেই এ নিয়ে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁচল থানায় অভিযোগ দায়ের করা হবে ৷ আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা ৷ বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এটা সবাই জানে ৷ আর দেশের যে কোনও রাজ্যের বাসিন্দা প্রয়োজনে যে কোনও রাজ্যে যেতে পারে৷ তা হলে বাংলাভাষীদের উপর এমন আক্রমণ চলবে কেন ? এটা মেনে নেওয়া যায় না৷’
বিষয়টি নিয়ে রাজ্যসভার সাংসদ মৌসম নুর জানান, ’এভাবেই বাংলাভাষীদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা চলছে ৷ বিভিন্ন রাজ্যে এই ঘটনা ঘটছে ৷ মুখ্যমন্ত্রী একুশে জুলাই এ নিয়ে বলেছেন ৷ দিল্লির জয়হিন্দ কলোনিতে এখনও আমাদের আন্দোলন চলছে৷ আমিও সেখানে গিয়েছিলাম৷ সেখানে বাংলাভাষী বলে বাঙালিদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে৷ বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেই এই ঘটনা ঘটছে৷ এই ঘটনা অবশ্যই সংবিধান লঙ্ঘন। দেশের রাজনীতিতে এই ধরনের অত্যাচার মেনে নেওয়া যায় না ৷ বিজেপির বাঙালি বিরোধী মানসিকতা এখন মানুষ বুঝতে পারছে৷ অথচ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির অনেক বাসিন্দাও কর্মসূত্রে বাংলায় রয়েছেন ৷ মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেছেন, আমাদের বাংলায় এমন ঘটনা একটি ঘটেছে বলে কেউ দেখাতে পারবে না ৷ সামনেই বিধানসভা নির্বাচন ৷ এটা ওদের নির্বাচনী কৌশল কি না, সেটা আমরা বুঝতে পারছি না৷ কিন্তু, এটা বিজেপির একটা নোংরা বাঙালি বিরোধী রাজনীতি।’
এ নিয়ে মালদার জেলাশাসক নীতিন সিংহানিয়া বলেন, ‘প্রশাসনের তরফে ওই পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে৷ তাঁরা মালদা ফিরলে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে৷’