২০২৪-এর ৯ অগাস্ট থেকে ২০২৫-এর ৯ অগাস্ট। নানা ঘটনায় আরজি কর কাণ্ডের বছরপার। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার নবান্ন অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এদিকে শুক্রবার পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই নবান্ন অভিযান নিয়ে কোনও অনুমতি চাওয়া হয়নি। তবে উত্তেজনা এড়াতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে। লালবাজার সূত্রে এ খবরও মেলে, শনিবার ভোর ৪টে থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শহরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় যানচলাচল নিয়ন্ত্রণও করা হয়। এই তালিকায় ছিল বিদ্যাসাগর সেতু, খিদিরপুর রোড, তারাতলা রোড, সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোড, জওহরলাল নেহরু রোড, হাইড রোড, আরআর অ্যাভিনিউ, রেড রোড, ডাফরিন রোড, মেয়ো রোড, এজেসি বোস রোড, এসএন ব্যানার্জি রোড, এমজি রোড, ব্র্যাবোর্ন রোড এবং হাওড়া সেতু। বেশ কয়েকটি রাস্তায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে টার্ফ ভিউ রোড, হেস্টিংস মাজার, ফারলং গেট এবং খিদিরপুর রোড।বহু জায়গায় বসানো হয় কন্টেনার, স্টিলের ব্যারিকেড। কিছু জায়গায় বসানো হয় অ্যালুমিনিয়ামের গার্ডওয়াল। শুধু তাই নয়, রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের তরফে ‘আইন ভাঙবেন না’, ‘শান্তি বজায় রাখুন’ পোস্টারও লাগানো হয়। তবে অশান্তি হওয়ার সম্ভাবনায় ব্যবস্থা করা হয়েছিল জলকামানের।
এদিকে কলকাতা হাইকোর্টের তরফ থেকেও বলা হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করার কথা। সেক্ষেত্রে প্রশাসনও মিছিলকারীদের পূর্ণ সহযোগিতার কথাও জানানো হয়। কিন্তু শনিবারের বেলা গড়াতে নবান্ন অভিযান আর শান্তিপূর্ণ থাকেনি। খুব সহজ ভাষায় বললে তিলোত্তমার বাবা–মা এদিনের এই নবান্ন অভিযানের ডাক দিলেও সমগ্র কর্মসূচিকে হাইজ্যাক করে নিতে দেখা গেল শুভেন্দু আর তার অনুচরবর্গকে। ফলে রাজনৈতিক কোনও পতাকা না থাকলেও গেরুয়া ছোঁয়ায় একাকার হয়ে যায় শনিবারের এই নবান্ন অভিযান। এদিনের এই অভিযানে আরও একটা ব্যাপার নজর কেড়েছে ভীষণভাবেই। তা হল সাধুসন্তদের এদিনের এই মিছিলে অংশ নেওয়া। আর এই সাধুসন্তদের মধ্যে থেকে উঠেছে ‘হর হর মহাদেব’ স্লোগান। আর এই সাধুসন্তদেরই দেখা যায় ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়তে। এদিনের এই নবান্ন অভিযান প্রশ্ন উঠেছে সাধু সন্তদের উপস্থিতি নিয়ে। কারণ, আরজি কর কাণ্ডের মতো এমন এক স্পর্শকাতর অভিযানে হঠাত্ সাধু সন্তরা কেন বা তাঁদের মুখে এই ‘হর হর’ ধ্বনি কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্নচিহ্ন। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি বিরোধী দলনেতা এই অভিযানেও হিন্দুত্বের তকমা লাগাতে চান? যে ইস্যুতে গত একবছর আগেও রাত দখলের ঘটনায় কলকাতায় আলোড়ন পড়েছিল সেই আন্দোলন এমন হিন্দুত্বের তকমায় লঘু হয়ে যেতে পারে কি না নিয়েও এদিন কোথাও একটা তৈরি হল ধোঁয়াশা। কারণ, ২০২৪-এর ১৪ অগাস্ট রাত দখলের অভিযানে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। আজ সেখানে কোথাও একটা বেড়ি পরানো হল না তো!
শনিবারের এই নবান্ন অভিযানে যাওয়ার মুখে ১৬ নম্বর জাতীয় সড়কের বিভিন্ন জায়গায় যে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিল পুলিশ তা টপকে যাওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। এই ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে আদালতের তরফ থেকে যে শান্তিপূর্ণ অভিযানের কথা বলা হয়েছিল তার প্রকৃতি বদলাতে থাকে শুবেন্দু অনুগামীদের হাতে। অন্যদিকে ততক্ষণে ডোরিনা ক্রসিংয়ে পৌঁছান তিলোত্তমার বাবা–মা। তাঁরা এদিন যে গাড়িতে আসেন তাতে লেখা ছিল, ‘বাংলা নিজের মেয়ের বিচার চায়।’ এদিকে এই ডোরিনা ক্রসিংয়েই ছিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী–সহ অগ্নিত্রা পল, অর্জুন সিং সহ বেশ কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক।
শনিবারের এই নবান্ন অভিযানে গিয়ে আহত তিলোত্তমার মা। তিলোত্তমার মায়ের আহত হওয়ার ঘটনায় বিজেপি নেতা কৌস্তভ বাগচি বলেন, ‘কাকিমার শাঁখা ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। আগে মেয়েকে মেরেছে। এবার শাঁখা ভেঙে দিয়েছে। এই তো পুলিশের চরিত্র।’ আন্দোলন মঞ্চ থেকেই গর্জে উঠতে দেখা গেল বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকেও। এদিন তাঁর সাফ কথা, ‘এটা হিন্দু বিরোধী সরকার। এই পুলিশের শাস্তি হবেই হবে হবে।’ তাঁর দাবি, ব্যাপক লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। ১০০ জনের বেশি আহত। পুলিশের লাঠির ঘায়ে আহত হন তিলোত্তমার মা–বাবাও।
এদিকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে দেখা যায় তিলোত্তমার মাকেও। তিনি স্পষ্ট জানান, তাঁর শাঁখা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তিনি এও বলেন, কলকাতা পুলিশ তাঁকে মেরেছে। যদিও, ডিসি পোর্টের দাবি, কেউই তিলোত্তমার মাকে মারেননি। এদিকে এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপই তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানেও উঠেছে প্রশ্ন। এমন এক আন্দোলনে উত্তেজনার পারদ যেখানে ক্রমশ বেড়েছে সেখানে কী কারণে তিলোত্তমার মা–বাবাকে সামনের সারিতে এগিয়ে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। প্রশ্ন উঠেছে এটা কি শুধুমাত্রই পলিটিক্যাল ডিভিডেন্ড নেওয়ার জন্য।
এরই মাঝে বারবার বাধার মুখে পরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দু’বার লেন বদলে পার্ক স্ট্রিটে পৌঁছে যান শুভেন্দু অধিকারী। শেষে বাধা পেয়ে পার্ক স্ট্রিটেই অবস্থান বিক্ষোভে বসেন তিনি।আর নবান্ন অভিযান আটকাতে যে ত্রি–স্তরীয় ব্যারিকেডের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেই ব্যারিকেড টপকে এগিয়ে যাওয়ার ক্রমাগত চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। শুভেন্দু অধিকারীও এই ব্যারিকেড ভেঙে এগোনোর চেষ্টা করেন। ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করতেই পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক ধস্তাধস্তি হয়। এরপরই বাধ্য হয়ে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। আটক করা হয় একাধিক আন্দোলনকারীকে। পুলিশকে মারধর করতেও দেখা যায়।
তবে সবকিছুর পর একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, যে তিলোত্তমার বাবা-মাকে সিবিআইয়ের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁদের এই ঘটনায় আর নতুন করে কিছু করার নেই। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে এখনও দেখাই করে উঠতে পারলেন না তিলোত্তমার বাবা-মা। এমনকী এই ঘটনাই কোনও উচ্চবাচ্যও করতে দেখা যায়নি শাহ বা নমোকে। সেখানে তিলোত্তমার বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ঠিক কী চাইছেন শুভেন্দু তা স্পষ্ট নয় অনেকের কাছেই। ফলে সব মিলিয়ে এতো বড় স্পর্শকাতর এক অভিযান দিকভ্রষ্ট হতে চলেছে কি না তা শনিবারের পর অবশ্যই প্রশ্নচিহ্নের মুখে।