কলকাতার দুর্গাপুজো মানেই থিম। আর এই থিমের পুজো দেখতে দেখতে চোখ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন কোথাও যেন মন খুঁজে বেড়ায সেই বিংশ শতকের ছয় বা সাতের দশকের পুজোকে। যেখানে পুজোর বাহ্যিক আড়ম্বর ছিল বড়ই কম। ছিল না এতো আলোর রোশনাই। অতি সাধারণ প্যান্ডেল গড়ে অতি নিষ্ঠাভরে হতো মাতৃ আরাধনা। কলকাতা বা কলকাতার উপকণ্ঠে সত্যিই এমন পুজোর খোঁজ মেলা কঠিন। তবে একেবারে যে নেই তাও বলা যাবে না। এই পুজোর খোঁজ আপনি পাবেন না পুলিশের তরফ থেকে প্রকাশিত ম্যাপে। কারণ, কোনওদিক থেকেই এটাকে হেভিওয়েট পুজোর তকমা দেওয়া যায় না। কারণ, না আছে তাদের বাহ্যিক আড়ম্বর। না এ পুজো বিগ বাজেটের। তবে পুরনো কলকাতার দুর্গাপুজোকে আপনি অনুভব করতে আপনাকে একবারের জন্য আসতেই হবে কালিন্দির এসকে বসু সরণিতে। যশোর রোড থেকে কালিন্দির বি–ব্লকের মাঠ পেরিয়ে বাঁ–দিকের রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোলেই নজরে আসবে ‘আমরা সবাই’-এর পুজো মণ্ডপ। ‘আমরা সবাই’ এর এই পুজো দেখতে দেখতে পা দিয়েছে ২৩ তম বর্ষে। সময়ের সঙ্গে খুব যে বদলেছে এই পুজোর চেহারা তা একেবারেই নয়। তবে হ্যাঁ, বদল এসেছে পুজো কমিটিতে। যাঁদের হাতে এই পুজোর শুরু, তাঁরা আজ অনেকেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কারও বা চুলে লেগেছে রুপোলি ছোঁয়া। ফলে পুজোর দায়িত্ব এখন এসে পড়েছে নতুনদের হাতে। যাঁরা পুজো শুরুর সময় ছিলেন একেবারে কিশোর মাত্র। পাশাপাশি বেড়েছে পুজোয় অংশ নেওয়া পরিবারের সংখ্যাও। পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে স্বল্প আলাপচারিতায় জানা গেল, ২০২৫–এর পুজোয় অংশ নিচ্ছেন খুব বেশি হলে শ’তিনেক পরিবার। এঁদের মধ্যে পুজোয় সক্রিয় বলতে হাতে গোনা ২৫টি পরিবারের বেশি নয়। এর থেকে এই পুজো সম্পর্কে আরও একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট যে, ‘আমরা সবাই’-এর এই পুজো যতটা না সর্বজনীন, তার থেকে অনেক বেশি পরিবার কেন্দ্রিক।
পুজো সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা সবাই–এর পুজো উদ্যোক্তারা জানালেন, সময়ের সঙ্গে পুজোর বহর বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কোনওভাবেই মূল প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনা হয়নি। কোনও পরিবর্তন নেই পুজোর প্রতিমায়। থিমের পুজো করার জন্য হাজারো অনুরোধ–উপরোধ এলেও পুজোর কর্মকর্তারা মায়ের সেই সাবেকি অবয়বকেই ধরে রেখেছেন। কারণ, পুজো উদ্যোক্তাদের ধারনা, মায়ের এই সাবেকি অবয়বে লুকিয়ে আছে এক বাঙালির ঐতিহ্য। আছে এক ভাবগম্ভীরতা, যা মা দুর্গার কল্পরূপের সঙ্গে মেলে। থিমের প্রতিমায় উধাও এই ভাবগম্ভীরতা, যা মোটেই কাম্য নয় পুজো উদ্যোক্তাদের কাছে।
২০২৫–এর পুজোতেও এই ট্র্যাডিশন বহাল রেখেছেন ‘আমরা সবাই’-এর উদ্যোক্তারা। এবারের পুজোতেও প্রতিমা হচ্ছে সেই সাবেকি ঘরানায়। মায়ের মৃন্ময়ী রূপ দানের দায়িত্বে রয়েছেন প্রতিমা শিল্পী বিশ্বজিৎ দে। প্রতিমা শিল্পী ভীষণ ভাবেই প্রত্যয়ী এই মাতৃরূপ দানে। এই প্রসঙ্গে তিনি এও দাবি করেন, ‘এখানে এসে মায়ের মাতৃপ্রতিমা দর্শনে দর্শনার্থীরা পাবেন এক আধ্যাত্মিক স্পর্শ।’ তবে এখানে একটা কথা না বললেই নয়। ২০২৫–এর পুজোর প্রতিমা গড়া হচ্ছে পুজো মণ্ডপেই। ফলে খুঁটি পুজো থেকেই একটা বেশ পুজোর ছড়িয়ে পড়েছে এসকে বসু সরণিতে।
পুজো মণ্ডপেও থাকে না বিশেষ কোনও চমক। চেহারায় তা একেবারেই সাবেকি। মণ্ডপ তৈরির দায়িত্বে রয়েছে অজিত পালের বিজয়া ডেকরেটর্স। স্থানীয়দের কাছে অজিত পাল অবশ্য অনেক বেশি পরিচিত ‘ভোম্বলদা’ নামেই। পাশাপাশি আলোতেও বিশেষ কোনও আকর্ষণ যে আছে তাও বলা যাবে না বলেই জানালেন পুজো উদ্যোক্তারা। সেই পুরনো বাল্বের মালা থেকে আধুনিক কিছু এলইডি লাইটে আলোকিত হয় পুজো প্রাঙ্গন। তবে থাকে দু–একটা আলোর গেট। না হলে দুর্গাপুজোর সেই আবহটা যে তৈরিই হতে চায় না যে। আলোকসজ্জার দায়িত্বে রয়েছেন রাজু দাস। তবে সব মিলিয়ে শঙ্খ–ঢাক–কাঁসরের আওয়াজের এক ভাবগম্ভীর পরিবেশে হবে ‘আমরা সবাই’-এর মাতৃ আরাধনা।
‘আমরা সবাই’-এর উদ্যোক্তারা জানান, এবারের পুজোর শুরু পঞ্চমীর দিন। পুজো উদ্বোধনে উপস্থিত থাকবেন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সঙ্গে হবে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। আর এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন স্থানীয়রাই। এই অনুষ্ঠানে নজর কাড়বে কচিকাঁচারা। তবে এবছর এই অনুষ্ঠানে থাকছে আরও একটি বিশেষ আকর্ষণ। পুজোর শুরু থেকে কাদের হাত ধরে কী ভাবে এগিয়ে গেছে এই পুজো তা তুলে ধরা হবে একটা ছোট ডকুমেন্টরিতে। এর পাশাপাশি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে তাঁদের উদ্দেশ্যেও, যাঁরা এই পুজোর সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে।
একদিকে যখন কলকাতা জুড়ে দুর্গাপুজোয় জাঁকজমকের অন্ত নেই সেখানে এতো অনাড়ম্বর ভাবে পুজো কেন সে প্রশ্নের উত্তরে কোথায় একটা হাল্কা হতাশার সুর ধরা পড়ল উদ্যোক্তাদের গলায়। এই প্রসঙ্গে তাঁরা একে একে তুলে ধরলেন এই পুজো নিয়ে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা। সব থেকে বড় প্রতিবন্ধক হল অর্থ। কারণ, এই পুজোর যে ফান্ড তৈরি হয় তা পিছনে রয়েছে এই ৩০০টি পরিবার। বাইরে থেকে কোনও ধরনের আর্থিক সাহায্য মেলে না বললেই চলে। শুধু তাই নয়, এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে নেই কোনও হেভিওয়েট নেতাও। ফলে সেখান থেকেও কোনও ধরনের আর্থিক সহায়তা আসার সম্ভাবনাও নেই। ফলে পুজোর বহর বাড়লেও ফান্ড সেই একই থেকে যাচ্ছে। ফলে ইচ্ছে অনেক থাকলেও হাত পা বাঁধা পুজো উদ্যোক্তাদের। সব মিলিয়ে বাজেট আড়াই লাখের বেশি নয়। তবে এই সামান্য পুঁজিতেও পুজো নিয়ে কোনও খামতি রাখতে নারাজ পুজো উদ্যোক্তারা। অষ্টমীর দিন পুজো মণ্ডপ থেকে দেওয়া হয় ভোগ। এই ভোগ সবার জন্যই। এরপর নবমীতে স্থানীয় প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছে যায় খাবারের প্যাকেট। বসিয়ে খাওয়ানোর ইচ্ছে থাকলেও তা হয়ে ওঠে না পুজো প্রাঙ্গনের পরিসর অত্যন্ত ছোট হওয়ায়। এরপর প্রথা মেনে দশমীর দিন হয় মাতৃ প্রতিমার নিরঞ্জন। সেখানেও চমক বা জমক বলতে প্রায় কিছুই নেই। ঢাকের বাদ্যির বোলে মা পুজো কমিটির সদস্যদের হাত ধরে এগিয়ে যান ঘাটের দিকে। এরপর সেখানেই মাকে এবছরের মতো জানানো হয় বিদায়। অশ্রুভরা নয়নে কানে কানে পাড়ার বৌয়েরা বলেন, ‘আবার এসো মা’।