শরতে যে দুর্গোৎসবে মাতে বঙ্গবাসী তার শুরু শ্রী রামচন্দ্রের হাতে, এমনটাই কথিত আছে। লঙ্কেশরাজ রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার প্রাককালে দেবীর আরাধনায় বসেন শ্রী রামচন্দ্র। কারণ, এই যুদ্ধে জিততে হলে দেবীর আশীর্বাদ যে প্রয়োজন তা জানতেন রাঘব। আর সেই কারণে এই শরতে দেবদেবীরা শয়নে থাকলেও দেবীকে উত্থিত করতে আয়োজন করেন এই পুজোর। তবে দেবী দুর্গা রামচন্দ্রের এই পুজো নিবেদনের আগে এক ছলনার আশ্রয় নেন। দেবী দুর্গার পুজোয় যে ১০৮ টি পদ্ম সমর্পণ করার কথা সেখান থেকে একটি পদ্ম সরিয়ে নেন দেবী দুর্গা স্বয়ং। কারণ, দেবী পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন কতটা ভক্তি সহকারে এই পুজোর আয়োজন করেছেন রামচন্দ্র। এদিকে পুজোয় বসে একটি পদ্ম কম নজরে আসতে শ্রী রামচন্দ্র স্থির করেন একটি পদ্মের জায়গায় তিনি নিজের চোখ নিবেদন করবেন দেবীকে। শ্রী রামচন্দ্রের এই ভক্তি দেখে আপ্লুত হন দেবী দুর্গা। রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। এরপরের ইতিহাস প্রায় প্রত্যেকেরই জানা। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর লঙ্কেশকে বধ করেন শ্রী রামচন্দ্র। এই যুদ্ধজয় উদযাপিত হয় দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমের এক প্রত্যন্ত স্থান ধনুষকোড়িতে। আর সেই কারণে সারা ভারতের সঙ্গে এই ধনুষকোড়িতে প্রতি বছর সাড়ম্বরে উদযাপন করা হয় ‘দশেরা’ বা ‘দশহরা’। লঙ্কেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার আগে শ্রী রামচন্দ্রের দেবী দুর্গাকে এই আবাহন–ই পরিচিত হয় ‘অকাল বোধন’ হিসেবে। এই অকাল বোধনকেই পুজোতে তুল ধরে খিদিরপুরের ভেনাস ক্লাব। শুধু তাই নয়, এই অকাল বোধনের ইতিহাস জানুক বাঙালি, তা ঐকান্তিক ভাবে চাইছেন এই পুজোর সভাপতি তপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই প্রসঙ্গে তপনবাবু জানান, প্রতি বছরই দুর্গাপুজোকে ঘিরে কলকাতায় মানুষের ঢল নামলেও অনেকেই জানেন না এই পুজোর ইতিহাস। তবে এই ইতিমহাস জানা একান্তই প্রয়োজন প্রতিটি বাঙালির। আদতে বাঙালি বসন্তকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। তা পরিচিত বাসন্তী পুজো নামে। এদিকে শ্রী রামচন্দ্রে এই অকাল বোধন এখন এতটাই জনপ্রিয় যে এই মুহূর্তে কলকাতা এবং শহরতলিতে বিরাট আকার ধারণ করেছে প্রায় প্রতিটি পুজোই সেখানে তুলে ধরা হয় হাজোরো থিম। তবে এরই মাঝে ট্র্যাডিশন বজায় রেখে এই অকাল বোধনকে সামনে রেখেই পুজো করে চলেছে খিদিরপুরের ভেনাস ক্লাব। ২০২৫–এ ৮০ তম বর্ষে পদার্পণ করলো এই পুজো।
পুজো বা প্রতিমা এই ‘অকাল বোধন’-কে ঘিরে তৈরি হলেও এর মণ্ডপ তৈরিতে তুলে ধরা হয় সমাজের কোনও আলোড়ন ফেলে দেওয়া ঘটনাকে। যা প্যান্ডেলের থিম হিসেবেই পরিচিত আমজনতার কাছে। ২০২৫–এমনই এক থিমের ওপর তৈরি হচ্ছে খিদিরপুর ভেনাস ক্লাবের পুজো মণ্ডপ। শীর্ষক ‘;আমি নারী, সব পারি‘ । এই থিমের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা হবে নারীজাতির ক্ষমতায়ণকেই। একদিকে নারীরা যেমন সংসার সামলান ঠিক তেমনই কর্মক্ষেত্রেও কোথাও তাঁরা আর এই মুহূর্তে পিছিয়ে নেই। ভারতের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও একজন নারীই। এমনকী অপারেশ ‘সিঁদুর’-এও নেতৃত্ব দিয়েছেন এই নারীরাই। পাশাপাশি এর পাশাপাশি এই নারীকেই আমরা দেখতে পাই ইটভাটাতেও তাঁর সন্তানকে পিঠে বেঁধে কাজ করতে। উত্তরবঙ্গের চা বাগানের ছবিটাও ঠিক একইরকম। আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রীড়াক্ষেত্রেও পুরুষদের থেকে মোটেই পিছিয়ে নেই নারীরাও।এই সব ঘটনা প্রমাণ করে নারীরা যথার্থই দশভুজা। আর একটা কথাও আছে, পুরুষের প্রতিটি সফলতার পিছনে থাকে নারীর অবদান।পুজোর থিমে ঠিক যেমন সাবেকিয়ানার ছোঁয়া ঠিক তেমনই তাঁরই সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তৈরি হয় মাতৃপ্রতিমাও।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা শ্রেয়, ২০২৫–এর মাতৃপ্রতিমা রূপদান করছেন শিল্পী বরুণ সাউ। তবে মাতৃপ্রতিমার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যে চক্ষুদান তা করবেন শিল্পী শুভজিৎ সাউ। এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা না বললেই নয়, শিল্পী শুভজিৎ সাউ বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। জন্ম থেকেই তিনি কথা বলতে না পারলেও তাঁর শৈল্পিক সত্ত্বার কাছে আমাদের মাথানত না করে উপায় নেই। মণ্ডপ থেকে শুরু করে পুজো প্রাঙ্গনের সম্পূর্ণ আলোকসজ্জার দায়িত্বে রয়েছে রিঙ্কু ইলেকট্রিক্স। খিদিরপুর ভেনাস ক্লাবের পুজোর আরও একটা বড় আকর্ষণ তাদের আলোকসজ্জা। ডায়মন্ড হারবার রোড থেকে মণ্ডপে প্রবেশ করার আগে সুদীর্ঘ পথ জুড়ে তৈরি হয় একের পর এক চোখ জুড়ানো আলোর গেট। এমন আলোকসজ্জা কলকাতা শহরের পুজোতে বর্তমানে বড়ই বিরল। এর পাশাপাশি মণ্ডপ সংলগ্ন বহুতলগুলোও সেজে ওঠে নানা আলোকে। প্যান্ডেল এবং থিমের দায়িত্বে রয়েছেন শিল্পী চিরঞ্জীব সাহা। আর এই পুজো ঘিরে প্রায় সারবাছর প্রস্তুতি নেন উদ্যোক্তা থেকে প্রতিটি সদস্য। কারণ, তাঁরা তাঁদের সাধ্যাতীত চেষ্টা করেন দর্শনার্থীদের ‘অকাল বোধন’ সম্পর্কে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। একইসঙ্গে বোঝান প্যান্ডেলের থিম সম্পর্কেও।
খিদিরপুরের এই পুজোর ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন হলেও কলকাতার অন্যান্য পুজোর তুলনায় বাজেট খুব একটা যে বেশি তা মোটেই বলা যাবে না।এই প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট তপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ২০২৫–এর বাজেট ২৪ লাখের আশপাশে। ভিড় সামলানো কঠিন হয় বলে উদ্বোধন হবে একটু আগেভাগেই, ২৪ সেপ্টেম্বর, তৃতীয়াতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখা যাবে নারীদের। আর পুজোর কয়েকটা দিন সপ্তমী থেকে নবমী খিদিরপুরের এই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে চলে অরন্ধন। কারণ, পুজো মণ্ডপেই থাকে দু বেলা পাত পেড়ে খাবার আয়োজন। পুজো শেষে দেবী প্রতিমা নিরঞ্জন দশমীতে করা সম্ভব হয় না, কারণ দশমী পর্যন্ত অনেকেরই এই পুজোতে আসা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেই কারণে মূলত দর্শনার্থীদের অনুরোধেই যথাসম্ভব পিছোতে হয় নিরঞ্জনের নির্ঘণ্ট । পুজো উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ২০২৫–এ প্রতিমা নিরঞ্জন হবে দ্বাদশীর দিন ৪ অক্টোবর।আর এই প্রতিমা নিরঞ্জনের সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য নতুন উদ্যমে পথ চলা শুরু হয় থিদিরপুর ভেনাস ক্লাবের পুজো উদ্যোক্তাদের।