শব্দ নিয়ে সচেতনার বার্তা বাগুইআটি রেল পুকুর ইউনাইটেড ক্লাবের

শব্দ’-ই ব্রহ্ম। এমনটাই কথিত আছে আমাদের পুরাণে। এদিকে মানব সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে শব্দের প্রাবল্যে আমরা হারাতে বসেছি বা ইতিমধ্যেই বিলীন হয়েছে বেশ কিছু অতি পরিচিত শব্দ। এই সব শব্দ ছিল আমাদের কাছে অত্যন্তই মধুর আমাদের মনের অগোচরে যে সব শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে বা হারিয়ে গেছে তাকেই দুর্গাপুজোর থিম হিসেবে তুলে ধরছে বাগুইআটি রেল পুকুর ইউনাইটেড ক্লাব। আর সেই কারণে থিমের শীর্ষকশব্দ এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল ২০২৫  ৭২ তম বর্ষে পা রাখল বাগুইআটি রেলপুকুর ইউনাইটেড ক্লাব।

যে সব শব্দ আমরা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছি সেই তালিকার একেবারে প্রথমেই থাকবে পাখিদের আওয়াজ। পাখিদের এই আওয়াজ নিয়ে এক কবিতাও লিখেছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার।পাখি সব করে রব কবিতার শুরু, ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল খুব ছোটবেলায় প্রায় প্রত্যেকেরই পাঠ্যে থাকতো এই কবিতা। খুব সহজ সরল এক কবিতা কিন্তু বড়ই বাস্তব।এই কবিতার ছত্রে ছত্রে তুলে ধরা হয়েছে বঙ্গের প্রকৃতিকে। পাখিদের ডাক আর সূর্যোদয় একে অপরের পরিপূরক তা যেন অগোচরে আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছিল মদনমোহন তর্কালঙ্কারের লেখা এই কবিতা। শুধু সূর্যোদয়ই নয়, সন্ধ্যাবেলায় সূর্য যখন অস্তাচলে তখনও কানে আসতো পাখিদের কলকাকলি। ঘরে ফিরতে হবে যে। সে ডাক বড়ই আলাদা, কোনও মিল নেই সকালের ডাকের সঙ্গে। এবার একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, আমাদের কানে এখন আর আসে না সে আওয়াজ। কোথায় যেন হারিয়ে গেল তারা। শুধু কী তাই, গহন আঁধারেও পেঁচা বা অন্য বেশ নিশাচর কিছু পাখির ডাক  রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিতো খানখান করে। সে আওয়াজ যে কোনও কারও  মেরুদণ্ডে শিহরণ বইয়ে দিতো। শহরে এ শব্দ শুনতে পাওয়া তো দূরঅস্ত, এমনকী  গ্রামে গেলেও আজকাল আর শোনা যায় না সে আওয়াজ। এর কারণ আমাদের মানব সভ্যতার বিকাশ। মানব সভ্যতা যতো বিকশিত হচ্ছে শহর থেকে গ্রামে ততই সৌন্দর্য হারাচ্ছে প্রকৃতি। শুধু শহর নয়, গ্রামেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বহুতল। তৈরি হচ্ছে আধুনিক মল। এসেছে নানা ধরনের সাউন্ড সিস্টেম। যার আওয়াজের প্রাবল্যে আমাদের কান পাতা দায়। আর এটা মানতেই হবে বহুতল গড়তে গিয়ে একে একে নিধন করা হয়েছে গাছপালাকে। নয়তো বহুতল গড়া হবে কোথায়! আর এই বৃক্ষ নিধনের ফলে সব থেকে বড় ক্ষতি পক্ষীকূলের। কারণ, তাদের বাসস্থান তো ছিল এই গাছগুলোই। আর বহু পাখি তাদের খাবার সংগ্রহ করতো এই গাছ থেকেও। ফলে গাছ যতো কাটা হয়েছে ততই কমছে পাখির সংখ্যা।  সঙ্গে আমরা হারিয়েছি তাঁদের আওয়াজও। এখানে একটা কথা না বললে বোধহয় ভুল হবে, আমাদের মধ্যে এমন কোনও মানুষ নেই যাঁরা পাখির শব্দ পছন্দ করেন না। সকালে পাখির ডাক মনকে ভাল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অথচ, আমাদের হঠকারিতাতেই আজ পক্ষীকূলের বিনাশ ঘটাচ্ছি।

শুধু কি তাই, আরও একটু বিস্তৃত ভাবে দেখলে পক্ষীকূলকে ধ্বংস করে প্রকৃতিতেও হানা হয়েছে এক বড়সড় আঘাত। এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে পড়তে বাধ্য। প্রকৃতি যখন এর প্রতিশোধ নেয় তা কিন্তু বড় ভয়ংকর। আমরা ভবিষ্যতের কথা না ভেবে এগিয়ে চলেছি মানব সভ্যতার জয়যাত্রার ধ্বজা উড়িয়ে। এই ভয়ংকর দিনগুলো আসার আগে এক সচেতনতার বার্তাই দিচ্ছে বাগুইআটি রেল পুকুর ইউনাইটেড ক্লাবশব্দ’-থিমের মধ্যে দিয়ে।এই থিম শুধু পক্ষীকূল আর পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার বার্তা দিচ্ছে তা নয়, একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেবে নাম না জানা কত শত পাখি আজ হারিয়ে গেছে এই বাংলার বুক থেকে।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা শ্রেয়, ২০২৫এর এই থিমের ভাবনায় রয়েছেন শিল্পী সোমনাথ তামলী। থিম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শিল্পী সোমনাথ তামলী জানান, মণ্ডপের প্রবেশের থেকে শুরু করে প্রতিমার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত থাকছে নানা ধরনের, নানা আকারের সব ইনস্টলেশন। এই সব নজরকাড়া ইনস্টলেশনের দৈর্ঘ্য কোনটা হবে ২০ ফুটও। মূলত পাখি আর প্রকৃতিকেই তুলে ধরা হয়েছে এই সব ইনস্টলেশনে। প্রবেশ পথে রাখা হয়েছে এক রঙিন ইনস্টলেশন, যা মূলত সূচিত করবে আমাদের মনকে। মানব সভ্যতার উন্নতিতে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে এটা যেমন ঠিক, ঠিক তেমনই আমাদের মনের গহিনে প্রকৃতি সম্পর্কে যে ছবিটা আঁকা হয়ে আছে তা রঙিন। প্রকৃতির সেই রঙিন ছবিটা হারিয়ে যাচ্ছে দেখে তখনই আমরা সচেতন হয়েছি। এছাড়াও থাকছে একটি বিরাট আকারের শালিখ পাখি। এখানে শিল্পী এও বলেছেন, আমরা এক শালিখকেঅপয়াবলে গণ্য করি অনেকেই, কিন্তু ইচ্ছাকৃতই একটা শালিখই রাখা থাকবে প্রবেশ পথে। এরা যে আমাদের মধ্যে থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে সেই বার্তাও এই ইনস্টলেশনের মধ্যে দিয়ে দিতে চান শিল্পী। মণ্ডপের ভিতরে থাকছে একটি গাছের ইনস্টলেশন। যার মধ্যে একইসঙ্গে দুটো ডানা দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাখির অস্তিত্বকে। সঙ্গে থাকবে কুঠার। অর্থাত্, বৃক্ষনিধনের সঙ্গে পাখিদের অস্তিত্ব যে আজ বড়ই বিপন্ন তা বুঝতে অসুবিধা হবে না আট থেকে আশি কারওরই। এর পাশাপাশি মানানসই আবহসঙ্গীত তো আছেই। পাশাপাশি একটি স্ক্রিনে দেখানো হবে মূকাভিনয়। আর এই মূকাভিনয়ে তুলে ধরা হবে পাখিদের অন্তরের কথা। মানুষের মতো পাখিদেরও একটা মন আছে তা আমরা ভুলে যাই। যাঁরা পাখি পোষেন তাঁরাই একমাত্র বোঝেন তাঁদের ভাষা। আমাদের মতো তাঁদের মধ্যেও মাতৃত্ব প্রকট। পাখির ছানাদের জন্য তাদের মা কী করে মুখে করে খাবার নিয়ে পৌঁছে দেয়, সে কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। কোনও বিপদে মা পাখি বুক দিয়ে আগলে বাঁচায় তাদের সন্তানকে। এ সব কথা আমরা কখনওই মাথায় রাখি না। আমদের চিন্তা বড়ই এককেন্দ্রিক, বড়ইস্বার্থপর।

শিল্পী আরও জানান, থিমের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই আর্ট ফর্ম আর সাবেকি ঘরানার মিশেলে রূপদান করা হচ্ছে মাতৃমূর্তির। মাতৃরূপদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিল্পী দেবপ্রসাদ হাজরার ওপর। ভাস্কর কৌশিক বিশ্বাস। থিমের সঙ্গে মানানসই হবে আলোকসজ্জাও। আলোক সজ্জায় রয়েছেন দীপঙ্কর দে। শিল্পী সোমনাথ তামলীর চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করে মণ্ডপ নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছেন বাপি দাস। মূকাভিনয়ে রয়েছেন শুভেন্দু মুখোপাধ্যায়। চিত্রগ্রহণ সম্পাদনায় রয়েছেন সমীরণ জানা। পাশাপাশি অঙ্কন ও নকশায় রয়েছেন ফারুক শেখ এবং শব্দ ও সঙ্গীতে দেবায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। এই থিম নিয়ে গবেষণা এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবে রূপায়ন করার ক্ষেত্রে পৌলমী বোসের কথা সর্বাগ্রে বলতেই হবে। 

থিম প্রসঙ্গে বাগুইআটি রেলপুকুর ইউনাইটেড ক্লাবের কমিটির সদস্য গৌরব বিশ্বাস জানান, ‘আমাদের থিমশব্দকেবল একটি শৈল্পিক সৃষ্টিই নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত বিবেকের প্রতিচ্ছবি। পাখি এবং প্রকৃতির শব্দ, যা একসময় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য ছিল, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের কারণে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এই থিমটির মাধ্যমে আমরা সমাজকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে এই কণ্ঠস্বরগুলি কেবল পটভূমি সঙ্গীত নয়, এগুলি আমাদের পরিবেশের হৃদস্পন্দন। যদি আমরা এর পুনরুদ্ধারের কাজ না করি, তাহলে আগামীকালের পৃথিবী আরও নীরব হয়ে যাবে। আর সেই কারণেই দুর্গাপুজোর থিম হিসবে এইশব্দকে বেছে নিয়েছি। কারণ দুর্গাপুজো কেবল উদযাপনের বিষয় নয়, বরং সচেতনতা, দায়িত্ব এবং মানবতার জাগরণের বিষয়ও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − fifteen =