কলকাতায় চারদিকে চলছে খুঁটি পুজোর আয়োজন। এই খুঁটি পুজোই রবিবার হল উত্তর কলকাতার লাহা কলোনির মাঠে। উদ্যোগে ‘সংঘতীর্থ’। আর সংঘতীর্থের খুঁটিপুজোতে বৃষ্টি হবে না, এটা হতেই পারে না। এটা যেন অলিখিত নিয়মে এক প্রথা হয়েই দাঁড়িয়েছে। রবিবারেও তার অন্যথা হয়নি। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ছিল কালো। সঙ্গে মাঝে মধ্যেই নেমেছে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। তার জের এদিনের খুঁটিপুজোয় পড়েনি তাও নয়। তবে সব মিলিয়ে বর্ষাসুরকে জয় করেই নির্বিঘ্নেই শেষ হয় এদিনে খুঁটিপুজোর অনুষ্ঠান।
এদিকে খাতায় কলমে পুজো আসতে এখনও মাস দুয়েকের বেশিই বাকি কিন্তু ঘরের মেয়ে উমা বছরে তো একবারই আসেন। তাও আবার দিন চারেকের জন্য। তাঁর এই আগমনকে ঘিরে প্রতিটি বাঙালি নিজেদের সমস্ত দুঃখ -কষ্ট, মান-অভিমান ভুলে মেতে ওঠেন তাঁর আরাধনায়। চারদিন এই কর্মযজ্ঞ চলে বাঙালির ঘরে-ঘরে। ফলে এর প্রস্তুতি আগে থেকেই নিতে হয় প্রত্যেককে। এই প্রস্তুতিরই বার্তা যায় খুঁটি পুজোর মধ্য দিয়েই। সঙ্গে এ বার্তাও যায়, মা আসছেন। সেই কারণে আজকাল দুর্গাপুজোর শুরুতে এই খুঁটি পুজোও এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে।
লাহা কলোনির মাঠে সংঘতীর্থের এই পুজো কিন্তু আজকের নয়। দেখতে দেখতে এই পুজো পার করেছে ৫৭ বছর। এবার পা দিল ৫৮-তে। এখানে আরও একটা কথা বলতেই হয়, তা হল সনাতনী প্রথাতেই এতকাল পুজো হয়ে এসেছে সংঘতীর্থের। তবে গত বছর থেকে ভাবনা-চিন্তায় বদল আনেন পুজোর উদ্যোক্তারা। শুরু হয় থিম পুজো। ২০২২-এর থিম পুজো বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সেইকারণে ২০২৩-এও থিম পুজো করার সিদ্ধান্তই নেন পুজোর উদ্যোক্তারা।
রবিবার ৬ অগাস্ট খুঁটি পুজোর মধ্য দিয়ে সংঘতীর্থের দুর্গাপুজোর ঢাকে পড়ল কাঠি। এদিনের এই খুঁটি পুজোর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা। ছিলেন তাঁর কন্যা ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পূজা পাঁজাও। সংঘতীর্থের পুজো পড়ে ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। ফলে নিজের ঘরের পুজো হিসেবে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় পুরপিতা সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। উপস্থিত ছিলেন শ্যামপুকুর থানার অফিসার ইন-চার্জ পরিতোষ ভাদুড়িও। আর সংঘতীর্থের ঘরের লোক তথা ক্লাবের সভাপতি হলেও দীপঙ্কর কুণ্ডু হলেও তাঁর পেশাগত একটা আলাদা পরিচয় আছে। তিনি সিটি সিভিল কোর্টের চিফ পাবলিক প্রসিকিউটারও বটে। সুতরাং বিশিষ্টজনের তালিকায় তাঁকেও রাখা যেতেই পারে। শুধু দীপঙ্কর কুণ্ডুই বা বলি কেন, এই ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও, যাঁদের পরিচয় দিতে গেলে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।
এদিন শুধু খুঁটিপুজোই যে হয়েছে তা কিন্তু নয়। মন্ত্রী শশী পাঁজার হাতে উদ্বোধন হল এবারের পুজোর ব্যানারেরও। এরই সঙ্গে সামনে চলে এল ২০২৩-এর সংঘতীর্থের দুর্গাপুজোর থিম। ২০২৩-এর থিম ‘প্রথা’। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক কিছুই মেনে চলি। সে পুজোই হোক বা অন্য যে কোনও ক্ষেত্রে। এই প্রথা মেনে চলাটাই অনেকে মনে করেন ঠিক। আবার কেউ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চান ট্র্যাডিশনকে। যেমন, বর্তমান প্রজন্ম বঙ্গ জীবনের সংস্কৃতি বা প্রথা থেকে অনেকটাই যেন বেরিয়ে এসেছে বা আসতে চাইছেন। কারণ, তাঁদের চোখে এই প্রথাগুলোর বিশেষ কোনও দাম নেই, সোজা কথায় এক্কেবারে বস্তাপচা। বর্তমান এবং পুরাতনের এই সংঘাতের আবহকেই সম্ভবত শিল্পী শঙ্কর পাল পুজোর থিম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নামকরণ করেছেন ‘প্রথা’। এখানে ‘সম্ভবত’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করার কারণ রয়েছে। খুঁটিপুজোর দিন পুজোর থিম বলা হলেও এতে ঠিক কোন দিকটা তুলে ধরা হবে তা বলতে নারাজ সংঘতীর্থের উদ্যোক্তা থেকে শিল্পীও। ওঁদের বক্তব্য, এটা চমকই থাকুক। আগে থেকে জেনে গেলে থিম পুজোর আকর্ষণটাই থাকে না।
এখানে বলে রাখা শ্রেয়, থিম ঠিক কী হবে তা কিন্তু পুজোর কয়েকদিন আগে জানানোটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন পুজো উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে। কারণ, থিম চুরি যাওয়ার ঘটনা বঙ্গে নতুন কিছু নয়। আর এমন ঘটনা ঘটার জেরে সতর্ক হয়েছেন শিল্পীরাও। এদিনের খুঁটি পুজোর সঙ্গে ছিল নিখরচায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থাও। ছিল ডেন্টাল ক্যাম্পও। স্বাস্থ্য শিবির বা রক্তদান শিবির কলকাতার মানুষজন দেখতে অভ্যস্ত হলেও দাঁতের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থার জন্য খুব একটা শিবিরের আয়োজন হতে দেখা গেছে বলে মনে করতে পারছেন না প্রায় কেউই। ফলে পুজোর শুরুতেই যে একটা বড় চমক দিল সংঘতীর্থ তা না মেনে উপায় নেই। এবার সবাই অপেক্ষায় যে, পুজোয় নতুন আর কী চমক দেখান পুজোর উদ্যোক্তারা।