ধৃত দুজনের ব়্যাগড হওয়ার পর চরম হীনমন্যতা থেকেই ব়্যাগ করার ইচ্ছে, জানাচ্ছেন মনোবিদরা

যাদবপুরের প্রথম বর্ষের পড়ুয়ার স্বপ্নদীপের মৃত্যুর ঘটনায় নানা তথ্য ও তত্ত্ব এখানে সামনে আসছে। এই ব়্যাগিং কাণ্ড এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করার ক্ষেত্রে মনোবিদরা জানাচ্ছেন, সাধারণত যাঁরা আগে ব়্যাগড হয়েছেন তাঁরা ভুগতে থাকেন এক চরম হীনমন্যতায়। যাঁরা র‍্যাগিংয়ের শিকার হন, তাঁদের মধ্যে একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বোঝানো হয় দেখ তুমি কত ছোট, কত ক্ষমতাহীন। কিন্তু এক মাঘে তো শীত যাবে না, তাই শিকারই যখন সুযোগ পান, তখন তাঁরা শিকারি হয়ে ওঠেন। তখন দুর্বলের উপর অত্যাচার করে প্রতিশোধের সুখ পাওয়ার আনন্দ যেন নেশার মতো চেপে বসে। যার ফলে তাঁরা যাখন সামনে নতুন কোনও শিকার পান তখন এঁরাই ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁর ওপর। আবার অনেকে ব়্যাগিংকে খো-খো খেলার সঙ্গে তুলনা করছেন। কারণ, খো খো খেলায় যেমন একজনের পিঠে এসে চাঁটি মারলে অপরজনকে চাঁটি মারাটাই খেলার নিয়ম, সেই চেনেই র‍্যাগিং, বুলিং, হেনস্থা, গার্হস্থ্য় হিংসার ঘটনার পরম্পরা চলতেই থাকে। আর এখান থেকেই ‘দলবদ্ধ অপরাধে সামাজিক ও ন্যায়বোধগুলি হাল্কা হতে শুরু করে। ব্যক্তিগত স্তরে হয়তো এরা কেউই বীরপুঙ্গব নন, কিন্তু সেই মানুষটাই দলে পড়ে অনেক ভয়াবহ ঘটনা চাইলে ঘটাতে পারে। ফলে এই ব়্যাগিংয়ের একটা টানা ধারাবাহিকতা যে চলে আসছে তাতে কখনও-ই ছেদ পড়ছে না। এদিকে সূত্র মারফৎ যে খবর মিলছে তাতে ধৃত মনোতোষ ঘোষ এবং দীপশেখর দত্ত সদ্য প্রথম বর্ষ পাশ করে দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছেন। মাত্র দিন তিনেক তাঁদের ক্লাস শুরু হয়েছে। এঁরাই যখন প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন সেই সময় তাঁরাও ব়্যাগিংয়ের শিকার হন। এমনটাই জানা গেছে মনোতোষের বন্ধুদের কাছ থেকে। এমনকী এরকমও শোনা গেছে যে কয়েক মাস আগে মনোতোষ নিজেই তাঁদের কাছে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে জানিয়েছিলেন তিনিও হস্টেলে সিনিয়রদের র‍্যাগিংয়ের শিকার। অপর ধৃত দীপশেখরের আইনজীবীর দাবি, তাঁর মক্কেলও অতীতে র‍্যাগড হয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, দুজনেই যদি র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে প্রথম বর্ষের পড়ুয়ারা হস্টেলে পা রাখতে না রাখতে সেই তাঁরাই কীভাবে র‍্যাগিংয়ে যুক্ত হয়ে পড়লেন? অতীতের কথা বা তাঁরা যে ঘটনার মধ্যে দিয়ে এসেছেন সেই স্মৃতি কী এত সহজেই ভুলে গেলেন?

এদিকে প্রথম ধৃত সৌরভ চৌধুরীকে জেরা করে যে দুই পড়ুয়াকে এ দিন পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তাদের নাম-ফোন নম্বর দিয়ে ছাত্র সংগঠন ফ্যাসের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল এঁরা নবাগতদের সাহায্য করবেন। কোনও ধরনের সমস্যা হলে তাঁরা যেন এঁদের সাহায্য নেন। কিন্তু বাস্তবে ছবিটা ছিল বড়ই ভিন্ন। যাঁদের রক্ষক হওয়ার কথা ছিল, তাঁরাই হয়ে উঠলেন ভক্ষক। কীভাবে ভক্ষক হলেন, তা নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

অর্থনীতির পড়ুয়া দীপশেখরের আইনজীবী রবিবার আদালতে বলেন, ‘ধৃত সৌরভ চৌধুরীকে সিনিয়র এবং দাদা হিসাবে চিনতেন দীপশেখররা।এছাড়া ওঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। এক বছর আগে আমার মক্কেল দীপশেখরও একই ভাবে র‌্যাগড হয়েছেন। দীপশেখর নিজেও ভিক্টিম। এই একই সুর শোনা গেছে দীপশেখরের মা সঙ্গীতা দত্তের গলাতেও। তিনি জানান, ‘আমার ছেলেকেও র‍্যাগিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। তাঁর উপর দিয়েও অনেক কিছু গিয়েছে। কিন্তু বাবা অসুস্থ বলে ছেলে কখনও বাড়িতে সে কথা জানায়নি। আমরা আত্মীয় মারফৎ তা জেনেছি। স্বপ্নদীপকে আমার ছেলে খুব পছন্দ করত। শুনেছি ছেলেটি সব সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকত। দীপশেখর ওকে বোঝাত। বলেছিল, তুই একদম চিন্তা করিস না, আমি তোর পাশে আছি।’ তবে মনোতোষের বাবা শান্তিনাথ ঘোষ অব্শ্য জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে যে র‍্যাগিংয়ের শিকার এমন কথা আগে কখনও সে বলেনি। এখানে একটু বলে রাখা ভাল, দীপশেখরদের আর্থিক অবস্থা যে খুব ভালো তাও কিন্তু নয়।পড়াশোনা না-জানা শান্তিনাথ সস্ত্রীক ফাস্ট ফুডের একটি দোকান চালান। অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া, দরমার বেড়ায় মাটি লেপা ঘরে বসবাস তাঁদের। খুব কষ্ট করে ছেলেকে পড়াচ্ছেন। শান্তিনাথের কথায়, ‘বেড পায়নি বলে হস্টেলে ওই ছেলেটি একদিন চারতলায় আমার ছেলের রুমে ছিল। পর দিন তাকে তিনতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শনিবারই ফোনে কথা বলার সময়ে আমার ছেলে সে কথা জানিয়েছিল। আর এখন শুনছি, আমার ছেলেকেই পুলিশ ধরেছে।’ এদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের এক পড়ুয়াও জানান, ‘আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে এই মনোতোষ কয়েক মাস আগেও নিজে র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিল। তা নিয়ে ও নিজেই অত্যন্ত ডিপ্রেশনের মধ্যে চলে গিয়েছিল।তারপরও এই ঘটনা!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × five =