একের পর এক কর্মকাণ্ডে মুখ পুড়ছে কলকাতা পুলিশের, ভর্ৎসিত হতে হল আদালতেও

কলকাতা পুলিশের কর্মকাণ্ডে যেন বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। একের পর এক ঘটনায় কলকাতা পুলিশর সম্ভ্রম যেন ধুলোয় লুটিয়ে দিচ্ছেন এক শ্রেণির পুলিশ আধিকারিক। এক গণধর্ষণের তদন্তে নির্যাতিতার বাড়িতে পুলিশকে যেতেই হবে বলে দুই পুরুষ পুলিশকর্মী গেলেন রাত দুটোর সময়! এমন ঘটনা নজরে আসতেই কলকাতা হাইকোর্টের প্রবল ক্ষোভের মুখে পড়ল রাজ্যের দুই থানা এবং তার ওসি-রা। কারণ, ‘তদন্তের স্বার্থে’ গভীর রাতে পুলিশের হোয়াটসঅ্যাপ কল করা বা দেখা করতে যাওয়া একজন নির্যাতিতার সম্ভ্রম ও গোপনীয়তা রক্ষার মতো মৌলিক অধিকার হরণ করার সামিল বলে মনে করে হাইকোর্ট। আর সেই কারণেই এই মামলায় কলকাতার লেক থানা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার নরেন্দ্রপুর থানাকে তীব্র ভর্ৎসনা করে আদালত স্পষ্ট জানায়, এ ধরনের পদক্ষেপ কখনওই কাউকে সুবিচার পাওয়ানোর সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না। এরপর, পুলিশের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে আদালতের নির্দেশে প্রায় বেনজির ভাবে ওই দুই থানার অফিসার-ইন-চার্জদের নিজেদের পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে নির্যাতিতাকে প্রতীকী ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করে লিখিত আকারে চাইতে হবে ক্ষমাও।

এই মামলার সূত্র ধরে আদালতের তরফ থেকে এ নির্দেশও দেওয়া হয় যে, আগামী দিনে কোনও নির্যাতিতার নিরাপত্তা বা প্রাণরক্ষার মতো জরুরি ক্ষেত্র ছাড়া কোনও পুলিশকর্মী বা অফিসার তাঁকে রাতে ফোন করা বা তাঁর বাড়িতে যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। যদি তেমন কিছু ঘটে, তা হলে তাকে নির্যাতিতার গোপনীয়তা ও সম্ভ্রম রক্ষার পথে অন্তরায় হিসেবেই ধরা হবে। একইসঙ্গে তা ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী বলেও গণ্য করা হবে।

প্রসঙ্গত, গত বছর নভেম্বরে বেদিক ভিলেজে একটি জন্মদিনের পার্টিতে পরিচিতদের সঙ্গে গিয়েছিলেন ওই তরুণী। অভিযোগ, সেখানেই গণধর্ষণের শিকার হন তিনি। মামলা দায়ের হয় বারাসত কোর্টে। ওই আদালতের নির্দেশে অভিযুক্ত চার জন এখন রয়েছেন জেল হেফাজতে। তাঁদের তিন জন জামিনের আবেদন করেন হাইকোর্টে। এই আবেদনের শুনানিতে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি ও বিচারপতি গৌরাঙ্গ কান্তের ডিভিশন বেঞ্চ মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দুই থানার আচরণে যারপরনাই বিস্মিত। বিশেষ করে লেক থানার ওসি এবং তদন্তকারী অফিসার যে ভাবে নিম্ন আদালতের নির্দেশ উড়িয়ে নিজেরাই আইনের ব্যাখ্যা করে এক অভিযুক্তকে ছেড়ে দিয়েছেন। পুলিশের এই ঘটনাকে পুলিশের ‘দাম্ভিক’ আচরণ হিসেবে দেখেছে আদালত।আদালতের সংশয়, পুলিশের এমন কাণ্ডে প্রশাসনের উপরে মানুষের ভরসা টলে যেতে পারে।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়, এরপর গত ৫ জুলাই নির্যাতিতার গোপন জবানবন্দি নেয় নিম্ন আদালত। সেই তারিখ ওই তরুণীকে জানাতে গত ২৯ জুন নরেন্দ্রপুর থানায় ই-মেল পাঠায় লেক থানা। কিন্তু ৪ তারিখ সন্ধে পর্যন্ত কোনও তথ্যই জানানো হয়নি নির্যাতিতাকে। সেদিন সন্ধেয় লেক থানার তরফে ফের যোগাযোগ করা হলে টনক নড়ে নরেন্দ্রপুর থানার। অতঃপর রাতে একজন অফিসার তরুণীকে হোয়াটসঅ্যাপে কল করে গোপন জবানবন্দির খবর জানানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু যোগাযোগ করতে পারেননি। এরপর দুই পুলিশকর্মী ওই তরুণীর বাড়ি যান খবর দিতে। তখন ঘড়িতে তখন রাত দুটো! এখানেই আদালতের প্রশ্ন, যেখানে লেক থানার কাছে তরুণীর মোবাইল নম্বর-সহ যোগাযোগের সবরকম পথ খোলা ছিল, সে ক্ষেত্রে তারাই বা কেন সরাসরি যোগাযোগ করল না? এই ঘুরপথ নেওয়ার কারণ কী? এরপর জামিনের শুনানিতে এর আগে আরও চমকে দেওয়ার মতো তথ্য আদালতের সামনে তুলে ধরেন নির্যাতিতার আইনজীবী ঝুমা সেন। যাবতীয় নথি দিয়ে তিনি জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্যাতিতা যোধপুর পার্কে একটি প্রদর্শনীতে গেলে এক ব্যক্তি সেখানে তাঁকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেন। এই ঘটনায় লেক থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তরুণী। এর পরে বারাসত আদালতে ট্রায়ালের সময়ে কোর্ট চত্বরে যোধপুর পার্কের সেই ব্যক্তিকে দেখতে পান তরুণী। সঙ্গে সঙ্গে তা জানান বিচারককে। জানা যায়, ওই ব্যক্তির নাম বিশাল পেরিওয়াল। হাইকোর্টে জামিনের শুনানিতে সেই প্রসঙ্গও এসেছে। ডিভিশন বেঞ্চ তার রায়ে লিখেছে, তরুণীর অভিযোগ পেয়েই নিম্ন আদালতের বিচারক বিশালকে লেক থানার হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তাঁর বিরুদ্ধে নিম্ন আদালত ফৌজদারি মামলা দায়ের করে পদক্ষেপের নির্দেশ দিলেও, তাঁকে ৪১-এ নোটিসে ডেকে জামিনে ছেড়ে দেয় লেক থানা। হাইকোর্টের মন্তব্য, ‘কী কারণে এমনটা করা হলো, সেটা পুলিশই ভালো জানে।’

এর পরেই বিশাল পেরিওয়ালকে মামলায় যুক্ত করে হাইকোর্ট। কেন তাঁর জামিন বাতিল হবে না, তার কৈফিয়ত তলব করা হয় লেক থানার কাছে। লেক ও নরেন্দ্রপুর থানার দুই ওসি এবং লেক থানার আইও-কে ডাকে আদালত। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, নিম্ন আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কোন যুক্তিতে তাঁরা ওই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার না-করে শুধু নোটিস দিয়ে ছেড়ে দিলেন? দুই ওসি এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়কে হাতিয়ার করে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন।

কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘যেখানে নির্যাতিতাকে কোর্টে দাঁড়িয়ে অভিযুক্ত মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন, সেখানে ওই নির্যাতিতার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে কী ভাবে পুলিশ অফিসাররা তরুণীর নিরাপত্তার বিষয়টি উড়িয়ে দিলেন!’ বেঞ্চের প্রশ্ন, ‘এটা কি আদালতের নির্দেশ অবমাননার সামিল নয়?’ এদিকে তরুণীকে গোপন জবানবন্দির দিন সম্পর্কে জানাতে দেরির কারণ হিসেবে নরেন্দ্রপুর থানা কাঠগড়ায় তুলেছে কম্পিউটার অপারেটরকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 − five =

preload imagepreload image