মঙ্গলবার রক্ষাকবচ চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে হাজির হয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনজীবী। তবে এখনই যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ করা হবে না, এই মর্মে মৌখিক আশ্বাস দিয়েছিলেন ইডি-র আইনজীবী। শেষ পর্যন্ত বুধবার নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সকাল ১১টা ৪০ নাগাদ সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দেন অভিষেক। চলে ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ। অবশেষে ৯ ঘণ্টা ১৫ মিনিট পর সিজিও থেকে বের হন তৃণমূলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অভিষেক।
রাত ৮টা ৪৯ মিনিটে বেরিয়ে বলেন, ‘এর আগে নিট ফল ছিল জ়িরো। এখন আরও দু’নম্বর কমল। মাইনাস টু। নিট ফল মাইনাস টু।’ পাশাপাশি এও জানান, বিজেপি তাদের ধূপগুড়ির হারের জ্বালা মেটাতেই তাঁকে সিজিও কমপ্লেক্সে ডেকে পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ করতে দেখা যায় অভিষেককে। সেই জন্যই অন্য কোনও দিন তাঁকে ডেকে না পাঠিয়ে বেছে বেছে বুধবার বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকের দিনই ডেকে পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। এই প্রসঙ্গেই অভিষেক এও বলেন, ‘এভাবে আমাকে ইডি দিয়ে ডেকে পাঠিয়ে ধূপগুড়ি পুনরুদ্ধার হবে না।’ সঙ্গে এও জানান, ‘টানা চারদিন জেরা করলেও মেরুদণ্ড বিক্রি হবে না। কারণ আমরা বশ্যতা স্বীকার করতে জানি না। তবে ইডিকে আমি দোষ দিই না। ওঁরা কর্মী মাত্র। নির্দেশ পালন করাই ওঁদের কাজ।’
তবে এদিন অভিষেকের নিশানায় ছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কর্মকাণ্ডও। এদিন বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রশ্ন তুলে দেন, ‘৯ বছর ধরে সুদীপ্ত সেন কাস্টোডিতে, কত মানুষ সারদার টাকা পেয়েছে? ১৪ মাস পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেলে, কী সুরাহা হয়েছে?’ একইসঙ্গে এ প্রশ্নও তুলে দেন, ক্যামেরার সামনেস, টিভির পর্দায় যাঁদের হাত পেতে টাকা নিতে দেখা যায়, তাঁদের ডাকা হচ্ছে না কেন বা কখনও হাইকোর্ট তা বলে না কেন তা নিয়েও।এরই রেশ টেনে ইডি-কে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে অভিষেক জানান, তাঁর বয়ান আদালতে জমা করুন তদন্তকারী আধিকারিকরা।কারণ, হিসেবে অভিষেক এও বলেন, প্রথম দিন থেকে আজও একই কথা বলে আসছেন তিনি। দু’মাস-চার মাস অন্তর অন্তর ডাকা একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইডি-সিবিআই-এর। এর নির্যাস শূন্য। দোষীরা শাস্তি পেয়েছে বা কেউ ন্যায় বিচার পেয়েছেন, ইডি-সিবিআই এমন নজির দেখাতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন অভিষেক।এরপর এদিন অভিষেক এও জানান, ইডি-র সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতে প্রয়োজন পড়লে ফের আসবেন বলেও জানিয়ে এসেছেন। নয় বা সাড়ে নয় ঘণ্টা নয়, দরকার পড়লে ২৪ ঘণ্টার জেরাতেও আপত্তি নেই বলে জানান তিনি।
এদিন প্রাথমিক নিয়োগ মামলায় এখনও ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তৃণমূল সাংসদকে। সেই আবহেই অভিষেককে ‘বাঘের বাচ্চা’ বলে উল্লেখ করলেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে অভিষেককে হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনিও।
এদিকে বুধবার জাতীয় স্তরে ইন্ডি জোটের সমন্বয় বৈঠক ছিল। আর বুধবারই অভিষেককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হতে নোটিস দেয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। তাতে বিরোধী জোটের সমন্বয় বৈঠকে না গিয়ে, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টেরেটের র সামনেই হাজির হন অভিষেক।এদিকে বিরোধী জোটের বৈঠকের দিনই কেন অভিষেককে ডাকা হল, সেই প্রশ্নে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজনীতি।
এই প্রসঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ জানান, ইন্ডি জোটের বৈঠকে যাতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় না যেতে পারেন, তার জন্যই আজ নোটিস দেওয়া হয়েছে। আমি অভিষেককে ধন্যবাদ জানাই অভিষেককে যে, বাঘের বাচ্চার মতো পরোয়া করেনি। চিঠি দিয়ে বলতেই পারত যে জোটের বৈঠক রয়েছে, যেতে পারবেন না। কিন্তু ‘মুখোমুখি হব’ বলে গিয়েছেন। অন্যায় ভাবে ডেকে পাঠানো, নিরপরাধ মানুষকে হেনস্থা করা, অপরাধ। কেন্দ্রীয় সংস্থা, প্রতিষ্ঠানকে সম্মান করি। দুঃখ হয় যখন ক্ষমতার জোরে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র অপব্যবহার করে।’
এদিকে মঙ্গলবার দিল্লিতে বৈঠক শেষে বিজেপি বিরোধী জোটের তরফ থেকে কংগ্রেস নেতা কেসি বেণুগোপাল বলেন, ‘সমন্বয় কমিটির সদস্য অভিষেককে আজকেই তলব করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। এই ঘটনা কেন্দ্রের প্রতিহিংসার রাজনীতির উদাহরণ।’ একইসঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’র তরফে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতেও রয়েছে ‘বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতি’র প্রসঙ্গ।
এদিকে এর আগে অভিষেককে একাধিকবার ডেকেছে সিবিআই। কিন্তু প্রতিবারই মাথা উঁচু করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দপ্তর থেকে বেরিয়ে এসেছেন তৃণমূল সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। বলেছেন, ‘প্রাণ গেলে যাক। তবু মাথা নত করব না।’ এবার বুধবার হাজিরা দেন ইডির দফতরে। আর বুধবার যখন সিজিও কমপ্লেক্সে অভিষেককে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তখন তাঁর সেই কথাই ট্রেন্ডিং এক্স হ্যান্ডেলে- ‘এবি ঝুঁকেগা নেহি’। মাথা নিচু করব না।
এদিকে সূত্রে খবর, মঙ্গলবার গভীর রাতে ইডি কর্তাদের সঙ্গে তদন্তকারী আধিকারিকদের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর অভিষেকের জন্য তৈরি করা হয় প্রশ্নমালা। এদিন বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট থেকে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। ইডি সূত্রে দাবি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়, লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের সঙ্গে বর্তমানে তাঁর সম্পর্ক কী? তাঁর কাছে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের দায়িত্ব থেকে অব্য়াহতি নেওয়ার কোনও নথি কি রয়েছে?
লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অফিস থেকেই এস ডি কনসালটেন্সির কাজকর্ম পরিচালনা এবং পরিবর্তে মোটা টাকা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে ঢোকার অভিযোগ উঠেছে। অভিষেককে এবিষয়ে কী জানেন, তাও জানতে চাওয়া হয়। এদিকে আবার তাপস মণ্ডল জানিয়েছেন, কুন্তল ঘোষের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, মানিক ভট্টাচার্যের অফিসে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র অভিষেকের বার্তা নিয়ে যেতেন। এ বিষয়ে অভিষেকের কী বক্তব্য, তা-ও জানতে চাওয়া হয়।