বার্সেলোনায় প্রবাসী ভারতীয়দের সম্মেলনে প্রকৃত অর্থেই দেশের নেত্রীর ভূমিকায় দেখা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই গানের লিড যিনি দিচ্ছিলেন তিনি মমতাকে স্বাগত জানাতে গিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করে বসেন। আর তাতেই গোটা হল ফেটে পড়ে হাততালিতে। পরক্ষণে অবশ্য ভুল শুধরে নেন ওই মহিলা। এদিনের অনুষ্ঠানে মমতা একদম শেষে বলতে উঠে ভারতের ঐক্য এবং বৈচিত্রের মধ্যে মিলনের পরম্পরা তুলে ধরেন। পাশাপাশি এদিন মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে উঠে আসে প্রায় প্রত্যেক রাজ্যের সংস্কৃতির ঐতিহ্য। তবে এদিন তাঁর বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণজনিত কোনও কথা বলতে দেখা যায়নি। সব প্রদেশের মানুষকেই একটা সুতোয় গেঁথে দেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য এবং তাঁর এই ভূমিকাই বুঝিয়ে দিয়েছে, তিনি বাংলার শুধু প্রতিভূ নন বরং সমগ্র দেশের হয়েই প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
এরই পাশাপাশি তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠল ভারতীয়ত্বের বৈশিষ্ট্য। এদিন তাঁর বক্তব্য রাখতে গিয়ে জানান, ‘আমার একটাই মতবাদ, মানবতাবাদ। আর ভিন্ন সংস্কৃতি থাকলেও সবাই একসঙ্গে কাজ করলেই দেশের উন্নতি সম্ভব।’ একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন যা ছুঁয়ে যায় প্রবাসীদের মন। কারণ, এমন সহজ ভাবে কাউকে এটা বলতে শোনা যায়নি। এটাই মমতার ইউএসপি মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
এখানে বলে রাখা শ্রেয়, এদিনের বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেন প্রবাসী ভারতীয়রা। এদিনের এই অনুষ্ঠানে তামিল, মালয়ালম ভাষাতেও সম্বোধন করতেও দেখা যায় মমতাকে। এক সর্দারজিকে দেখেই যেমন তিনি ‘সৎ সিরি অকাল’ বলে সম্বোধন করেছেন, তেমনই গুজরাটিতে ‘কেমছ’ উচ্চারণ করেন। বাংলার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় ভাষাও বোঝান। শুধু তাই নয়, বলেন নেপালি ভাষাও। এভাবে তাঁর বক্তব্যে, তাঁর কথায় বার্তায় ধরা পড়ে বিভিন্নতার মাঝে একতার বার্তা। যেটা মন ছুঁয়ে যায় প্রবাসীদের।
আর একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, স্পেনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীনেশ পট্টনায়কের বক্তব্য। দীনেশ বারবার ‘দিদি’ সম্বোধনে বোঝালেন, সারা দেশের প্রেক্ষিতে এখন মমতার গুরুত্ব কতটা। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জানান, পাঞ্জাবি, সিন্ধ্রি, বাঙালি, তামিল সব ধরনের লোক রয়েছেন এখানে। উল্লেখ করলেন, দিদি বহুমুখী প্রতিভার, উনি শুধু রাজনীতিক নন। এদিকে এ তথ্যও মিলেছে যে, মমতা আসবেন শুনেই তিন দিনে একশো মানুষ রেজিস্ট্রেশন করতে চেয়েছেন।
এই সব সম্প্রদায়ের মানুষকে দেখে মমতাও বলেন, ‘এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। বাংলার কারও সঙ্গে দেখা হলে তো খুশি হই। এটা মাতৃভাষা। কিন্তু সবাইকে সম্মান দিই। ছুটি দেওয়া হয় ছট পুজোতেও। মারাঠি ভাইবোনের উদ্দেশে বলব, গণপতি বাপ্পা মোরিয়া। এবার ইউনেস্কো বাংলাকে ‘ডেস্টিনেশন ট্যুরিজম’-এর জন্য ঘোষণা করেছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিরাট।’ এদিন বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’-র কথাও উঠে আসে তাঁর ভাষণে। সেই প্রসঙ্গ উঠলেও কিন্তু বোঝান, সেখানে সব প্রদেশের নেতারা আসেন। মতবিরোধ ভুলে সবাই দেশের জন্য একসুরে বাঁধা। দেশ ও দেশের সংস্কৃতি আসলে এই গেঁথে দেওয়ার কাজ করে। আসল কাজ, সবাইকে নিয়ে দেশের উন্নয়ন। তাঁর বক্তব্যে এসেছে বাংলার উন্নয়ন প্রসঙ্গ। বলেন, ‘৩৪ বছরের শাসনে যা দেখেছিলেন, তার থেকে অনেক বদলে গেছে বাংলা। দিঘার সৈকতের কাছে বিশাল জগন্নাথ মন্দির হচ্ছে। পুরীতে প্রচুর বাঙালি যান। আমাদের কৃষক, হস্তশিল্পী সেরা। আমরা শুধু উন্নতি চাই, আর কিছু না। সংহতি, প্রত্যেকের মধ্যে ভালোবাসা চাই। সবাই একত্রিত হলেই সব কিছু সম্ভব।’ এরই পাশাপাশি বাংলার সংস্কৃতি, নোবেলজয়ীদের কথাও বললেন। অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রচুর মহিলাও। তাই নারী উন্নয়ন প্রশ্নে বলেন, লোকসভায় আমার দলের ৩৫ শতাংশই মহিলা। পকেট মানি হিসাবে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ দেওয়া হয়। ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’ দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার জন্য স্মার্ট কার্ড আছে। দুই লক্ষ হস্তশিল্পী আছে। দুই লক্ষ লোকপ্রসার শিল্পীকে কাজে লাগানো হয়। এনআরআই বন্ধুদের জন্য ‘আপন বাংলা’ অ্যাপ রয়েছে। বিনিয়োগ করতে চাইলে বা সমস্যায় পড়লে ক্লিক করুন। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্যও অ্যাপ রয়েছে। এই সব কর্মকাণ্ড ও বস্তুত ওই এনআরআই দের মন ছুঁয়ে যায়। ওরাও আপন করে নিলেন মমতাকে, যিনি দেশেরও নেত্রী।