শুভাশিস বিশ্বাস
কলকাতার শীত মানে কুয়াশা মোড়ে ভোরে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। মিঠে রোদ্দুরে গা এলিয়ে বসে থাকা। নিউমার্কেট থেকে হাতিবাগানে শীত পোশাকের ভিড়। ধোঁয়াটে সন্ধে। সেজে ওঠে পার্ক স্ট্রিট। দোকানে দোকানে দাঁড়িয়ে পড়ে ক্রিসমাস ট্রি। নাকে ভেসে আসে কেক-পেস্ট্রির গন্ধ। শীতে ধুলো মাখা ধূসর কলকাতাও যেন চির সবুজ হয়ে ওঠে রঙিন আলো আর তারুণ্যের ভিড়ে।বড়দিনের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে গিয়েছে কেক। কেক ছাড়া বড়দিন পালন এককথায় অসম্ভব। এই শহরে ক্যাফে কিংবা বাহারি কেকের ঠেক এমনিতে কম নেই। আর,এখন তো অনলাইনের যুগ। ক্রিসমাসের আগে স্ক্রিন টাচেই বাড়িতে পৌঁছে যায় কেক-পেস্ট্রিরা। এই সহজলভ্যতার যুগে কলকাতা শহরে এখনও এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে লুকিয়ে আছে কেকের স্বর্গরাজ্যে। আর এই বড়দিন আর কেকের কথা কলকাতা বললে মূলত দু’টি নামই সবার আগে মনে আসে। একটা হল পার্কস্ট্রিট আর অপরটি বো ব্যারাক। যেখানে পুরনো কলকাতা এবং কেকের ইতিহাস এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
ক্রিসমাসের দিন পার্কস্ট্রিটে হাঁটলে যেমন কলকাতার এক অন্যরূপ চোখে পড়ে, তেমনই বো বারাকেরও আছে সেই রকমই একটা আলাদা ক্রিসমাস স্পেশাল ফিলিংস। বড়দিনে কেক কিনতে যেমন লোকজন ধর্মতলার নিউ মার্কেটে নাহুমস ছোটেন, তেমনই কেক কেনার জন্য অন্যতম ডেস্টিনেশন মধ্য কলকাতার বো ব্যারাক অঞ্চল। বউবাজার থেকে একটুখানি। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর গায়েই এ শহরের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যের অ্যাংলো পাড়া। বড়দিনের আগে থেকেই নিজের স্টাইলে সাজতে শুরু করে বো ব্যারাকও৷ আজও এখানে জীবন জেগে ওঠে ক্রিসমাসের সময়। নাচগান, আলো, স্ট্রিট ফুডের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে চত্বর। সারাবছরের শহরে একপাশে পড়ে থাকা অ্যাওয়ে পাড়াটায় যেন প্রাণের দীপ্তি ঠিকরে ওঠে এসময়ে। পার্কস্ট্রিটের মতোই স্থানীয় চার্চ থেকে বো ব্যারাকের অলিগলিতে ঢুঁ মারতেই নজরে আসে চূড়ান্ত ব্যস্ততার ছবি। কেউ নিজে দাঁড়িয়ে বাড়ি রঙ করাচ্ছেন। কেউ সাজাচ্ছেন ঘর। কেউ দেখে নিচ্ছেন শেষ মুহূর্তে কী আনতে হবে। একই সঙ্গে চর্চা চলছে ২৫ ডিসেম্বর কী পোশাক পরবেন তারও। পোশাকে অন্যকে মাত দেওয়া যায় কী ভাবে তা নিয়েও চলে গবেষণা।
তবে এখানে পা রাখলেই মালুম হয় ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস বিজড়িত কলকাতার এই স্থান। শোনা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের থাকা ও রসদ সরবরাহের জন্য তৈরি হয়েছিল এই স্থান। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়েছে অনেকদিন হল, কিন্তু বো বারাকের ইতিহাস আজও আছে। ক্রিসমাস ও ইংরেজি নববর্ষ এলে সেসব ইতিহাস আবার জেগে ওঠে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে। ব্রিটিশ সৈন্যরা যখন ভারত ছেড়ে নিজেদের দেশে পাড়ি দেয়, তখন থেকেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এখানে বাস করছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ১৩২টি পরিবারের বাস এখানে। আর ৮০ শতাংশ লোকজনই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান।
বড়দিনের একটু আগে থেকেই শুরু হয় নানারকম কর্মকাণ্ড। এখানে নিজের হাতে কেক, রেড ওয়াইন তৈরি করেন অনেকে। এরপর শুরু হয় বিক্রি। কেক, রেড ওয়াইন ছাড়াও থাকে ক্রিসমাস ট্রি-সহ নানা রকম জিনিস। এই সময় যেন অন্য এক মেজাজই দেখা যায় বো ব্যারাকে।
আর এই বো ব্যারাকের কথা বলতে গিয়ে এখানকার কেকের কথা না বললে অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যাবে। বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে কেক তৈরি করছেন স্থানীয় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারগুলি। বড়দিনে এখানে যে কেক তৈরি হয়, তা আদতে তৈরি হয় পরিবারের আত্মীয়দের দেওয়ার জন্যই। তবে ক্রিসমাসে কেক বিনিময়ের পর যা বাঁচে, তাই বিক্রির উদ্দেশ্যে পসরা সাজানো হয়। সেখানকার ফ্রুট কেক, ছানার কেক, ওয়াইন কেক সবের গন্ধে ম-ম করে বো-ব্যারাক চত্বর। ব্যস্ত দোকানদারও। এই সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে কেক কিনতে। বছরের অন্য সময়ে বো বারাকে এলে ব্রিটিশদের প্রাচীন ইতিহাসের কথা মনে পড়বে আর বড়দিনের সময় এলে বোঝা যায় ক্রিসমাস সেলিব্রেশন কাকে বলে। এই শহর অনেক পালা বদলের সাক্ষী হলেও আজও এই বো ব্যারাকের বদল হয়নি।