মঙ্গলবার রাত ন’টা নাগাদ কৃষক নেতারা ঘোষণা করেন, ‘এই রাতের জন্য সিজফায়ার অর্থাৎ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হল। বুধবার আবার আমাদের গন্তব্যের দিকে যাব।’ প্রসঙ্গত, অনুরোধ-উপরোধ-বৈঠক কোনওটাতেই কোনও কাজ হয়নি। ফলে নিজেদের একাধিক দাবি নিয়ে ‘দিল্লি চলো’ অভিযান শুরু করেন পঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশের ২৫ হাজার কৃষক। তাঁদের সঙ্গে রয়েছে পাঁচ হাজার ট্র্যাক্টর। মঙ্গলবার তাঁরা মিছিল শুরু করার পরেই পঞ্জাব-হরিয়ানা শম্ভু সীমানায় পুলিশের সঙ্গে প্রবল ধস্তধস্তি হয় আন্দোলনকারীদের। এক সময়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে ড্রোন থেকে টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটানো হয়। শুধু তাই নয়, উত্তর ভারতে প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে তাঁদের উপর বারবার জলকামান চালানো হয়। লাঠি উঁচিয়েও অনেক জায়গায় তেড়ে যেতে দেখা গেছে উর্দিধারীদের। তবে তাঁদের হতদ্যোম করা যায়নি। এদিকে সূত্রে খবর, তাঁরা ক্রমশ দিল্লির দিকে এগোচ্ছেন।
তবে মঙ্গলবারের এই সিজফায়ার শব্দের প্রয়োগে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, দেশের অন্নদাতারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এই আন্দোলন তাঁদের কাছে যুদ্ধের থেকে কম কিছু নয়। এর পাশাপাশি তাঁরা এ-ও জানিয়েছেন, অন্তত আগামী ৬ মাসের রসদ ও ডিজেল তাঁরা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্যও প্রস্তুত তাঁরা। সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন আগের বার ১৩ মাস তাঁরা দিল্লি অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন।
এদিকে এই আন্দোলনকে ঘিরে কার্যত দুর্গের চেহারা নিয়েছে রাজধানী দিল্লি এবং সংলগ্ন এলাকা। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুণ্ডা জানিয়েছেন যে, সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ না করে শস্যের উপর ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের (এমএসপি) গ্যারান্টি দেয় এমন একটি আইন তাড়াহুড়ো করে আনা যাবে না এবং প্রতিবাদী কৃষক গোষ্ঠীগুলিকে এই বিষয়ে সরকারের সঙ্গে একটি সদর্থক আলোচনার জন্যও বলেছেন তিনি।
এদিকে, মঙ্গলবার শম্ভু সীমান্তে পুলিশের সঙ্গে কৃষকদের সংঘর্ষের পরে দিল্লি পুলিশ টিকরি সীমান্ত সিল করে দিয়েছে। দু’দিকেই পাঁচ ফুট লম্বা সিমেন্ট ব্লক এবং বহুস্তরীয় ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই অবস্থা রাজধানী দিল্লিরও। সোমবার রাত থেকে জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে লালকেল্লাতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ। মোতায়েন করা হয়েছে বিশেষ সুরক্ষা বাহিনী। মঙ্গলবার সারাদিনই বন্ধ ছিল দিল্লি মেট্রোর প্রায় দশটি এনট্রি গেট। এয়ারপোর্ট অথরিটির পক্ষ থেকেও যাত্রীদের বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে প্রবেশ বাধ্যতামূলক জানিয়ে দেওয়া হয়। এরই পাশাপাশি হরিয়ানা এবং পঞ্জাবের সাথে রাজস্থানের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং সাতটি জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । হরিয়ানা পুলিশ খানাউরিতে পঞ্জাবের কৃষকদের উপর লাঠিচার্জও করে বলে সূত্রে খবর।
কৃষকদের সংগঠন এখনও দিল্লিতে পৌঁছতে না পারলেও আন্দোলনের ‘উত্তাপ’ এবং প্রভাব বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে রাজধানীতে। ২০২০ সালের কৃষক আন্দোলন ফিরতে পারে আবার, গোয়েন্দাদের এমনই রিপোর্ট উদ্বেগ বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের। পঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্ট মঙ্গলবার কৃষকদের ‘দিল্লি চলো’-র সংক্রান্ত দায়ের করা দুটি আলাদা আবেদনে কেন্দ্রীয় সরকার এবং হরিয়ানা ও পঞ্জাব সরকারকে নোটিস জারি করেছে। সেখানে সব পক্ষকেই অনুরোধ করা হয়েছে, পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তবে তা নিয়ে কোনও পক্ষই কিছু বলেনি। বরং আন্দোলন দীর্ঘ মেয়াদি হতে চলেছে আন্দাজ করে মঙ্গলবার হরিয়ানা পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) তাঁর ফোর্সকে নির্দেশ দেন, কৃষকরা যদি ‘আক্রমণাত্ম’ হয়ে ওঠেন তা হলে সংযম দেখানোর কোনও প্রয়োজন নেই। আত্মরক্ষার্থে পাল্টা আক্রমণ করতে হবে। লাঠি ব্যবহার করতে তিনি বারবার নির্দেশ দিয়েছেন। কৃষক নেতারা অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ করেছে। পুলিশকে সমুচিত জবাব দিতে শম্ভু সীমানায় ট্র্যাক্টর দিয়ে পুলিশের তৈরি অত্যাধুনিক ব্যারিকেড ভেঙে দেন।
যদিও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার তরফ থেকে জানানো হচ্ছে, এই আন্দোলন তো কিছুই নয়। আসলটা শুরু হবে ১৬ ফেব্রুয়ারির পর। যেখানে কৃষকদের সঙ্গে অংশ নেওয়ার কথা সারা দেশের প্রায় ২০ কোটি কৃষকের। এই বিক্ষোভে দেশের সমস্ত গ্রামে আন্দোলন শুরু করা হবে। সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতা এবং কেরালার প্রাক্তন বিধায়ক কৃষ্ণপ্রসাদ বলেছেন যে, ‘গ্রাম বন্ধ’-এর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সকলে। কৃষকদের আন্দোলনে এই প্রথমবারের মতো সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামে গ্রামে বন্ধের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এরই পাশাপাশি কৃষ্ণপ্রসাদের সংযোজন, তাঁদের সংগঠনেরই প্রায় দুই কোটি সদস্য এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। মোর্চার দাবি, সারা দেশের বিভিন্ন কর্মী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এবং দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত মানুষও ১৬ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে যোগ দিতে চলেছেন। এদিকে সূত্রে এ খবরও মিলছে, একদিনের ‘গ্রাম বন্ধ’ আন্দোলনের মাধ্যমে গ্রামের সব স্বাভাবিক কার্যক্রম ওই দিন বন্ধ থাকবে। মোর্চার তরফে কৃষ্ণপ্রসাদ বলছেন, সরকার তাদের দাবি না মানলে এই আন্দোলন আরও চলবে। তাঁদের সংগঠনের দাবি, কেন কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের উন্নতির জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা পূরণ হচ্ছে না।