‘কোনও একটি পার্টি কোথাও অনেক বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলে তা গণতন্ত্রের জন্যে শুভ হয় না। সব কিছুর কেন্দ্রীকরণ হতে থাকে। গণতন্ত্রের পক্ষে যা বিপদের।’ পাঁচ রাজ্যে যখন বিধানসভা নির্বাচন চলছে, ঠিক তখনই কলকাতায় এসে এমনটাই জানিয়ে গেলেন দেশের প্রাক্তন অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম । অর্থাৎ তার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, তিনি চান না কেন্দ্র বা রাজ্য, কোনও স্তরেই কোনও একটি দল দশ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকুক। কংগ্রেসের বর্তমান রাজ্যসভা সাংসদ তাঁর দলের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম চান না। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে চিদম্বরমের এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে বেশ চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। শনিবার জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জন ফেলিক্স রাজ ও অধ্যাপক প্রভাতকুমার দত্তের লেখা ‘ডেভলপমেন্ট, ডিসেন্ট্রালাইজেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ নামক বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন চিদম্বরম।
শুধু তাই নয়, শনিবার কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে চিদম্বরম নির্বাচনে যথেচ্ছ টাকার খেলা নিয়ে নাম না করে বেঁধেন বিজেপিকে।এরই প্রসঙ্গ টেনে এও বলেন, ‘গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে দুটি ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণ করছে। টাকা এবং ধর্ম।’ উদাহরণস্বরূপ চিদম্বরম বলেন, ‘এই যে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে, শুধু এই ভোটগুলিতেই ১৭৬০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।’ এরই পাশাপাশি তিনি এও জানান, নির্বাচনের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অভিযোগ করেন, বর্তমানে নির্বাচন এবং ধর্ম দুটোকে এক করে ফেলা হয়েছে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু ছিল ‘গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ’। বর্তমানে দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা কতটা করুণ, শনিবারের বক্তব্যজুড়ে ছিল যেন সেই আখ্যান। যার সুর তিনি বেঁধে দেন বক্তব্যের প্রথম ভাগেই। বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ভিতরটা ফাঁপা হয়ে গিয়েছে। মুখোশটা আকর্ষণীয়। কিন্তু, ভিতরে প্রায় ফাঁপা।’ আর তার মুখ্য কারণ হিসাবে নির্বাচনে টাকার যথেচ্ছ ব্যবহারকেই দায়ী করেন চিদম্বরম। তাঁর কথায়, ‘কয়েক দশক আগেও মাত্র ৫ বা ৫০ হাজার টাকা যথেষ্ট ছিল নির্বাচনের একজন প্রার্থীর জন্য। এখনকার একটি মিছিলেরও খরচ ১ কোটির উপর হয়।’ নির্বাচনে ধর্ম নিয়ে খেলার প্রসঙ্গ টেনে আনেন প্রাক্তন মন্ত্রী। তাঁর মতে, ধর্মনিরপেক্ষতার ভুল ব্যাখ্যা করে সেটিকে ‘তুষ্টি’র আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে তিনি এও বলেন, ‘আপনি যদি অ-হিন্দু হন, আপনার নিজেকে অর্ধ-নাগরিক মনে হবে। আপনি যদি মুসলিম হন তবে আপনি নাগরিক নন। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে সিস্টেমেটিক্যালি ভুল প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে।’ একইসঙ্গে তিনি এও জানান, রাজ্যের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কার্যত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘যুগ্ম তালিকায় থাকা বিষয়ে সংসদীয় আইন রাজ্যকে নিজের আইন প্রণয়নের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা আসলে রাজ্যের বিষয়বস্তু। আসলে কেন্দ্রীয় পুলিশ, কেন্দ্রীয় সংস্থা চাইলেই যে কোনও তদন্ত দখল করে নিচ্ছে।’ এরই পাশাপাশি‘এক দেশ, এক নির্বাচন’, ‘এক দেশ, এক রেশন’-এর মতো উদ্যোগগুলি চূড়ান্তভাবে অগণতান্ত্রিক বলেও মতপ্রকাশ করেন তিনি। সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের একসঙ্গে ২টি ফুলটার্ম তথা ১০ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকা উচিত নয় বলেও মত প্রকাশ করেন চিদম্বরম।
প্রসঙ্গত, ‘স্টেট ফান্ডেড ইলেকশনে’র দাবি আগেই তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচনে টাকা ছড়ানো নিয়ে একাধিকবার সরব হতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেই নির্বাচনে টাকা এবং ধর্মের ব্যবহার নিয়ে কলকাতায় এসে সরব হলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের রাজ্যসভার বর্তমান সাংসদ পি চিদম্বরম।