পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে শনিবার সকাল থেকেই তপ্ত ছিল রাজ্যের পরিস্থিতি। ভোটদানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গা থেকে অশান্তির খবর সামনে এসেছিল। রাত পর্যন্ত বিভিন্ন জেলা থেকে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর সামনে আসে। যদিও কমিশনের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে এই পরিসংখ্যানটা ১০। রবিবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে ঢোকার সময় নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা জানান, ‘এখনও পর্যন্ত পুলিশ ১০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে।’ পাশাপাশি পুনর্নির্বাচন নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি। এরপর সন্ধেয় পুনর্নির্বাচন কোথায় কোথায় হবে তা জানানো হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে।
তবে শনিবার ভোট শুরুর পর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে কার্যত অশান্তির ছবি ধরা পড়ে। বিভিন্ন জেলা থেকে বোমাবাজি, রক্তঝরার দৃশ্য সামনে আসতে থাকে। এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার শনিবার জানিয়েছিলেন, ‘আইন শৃঙ্খলার বিষয়টি রাজ্য পুলিশের। আমাদের কাছে যদি কোনও তথ্য আসে তা আমরা পুলিশকে জানাই। অনেক সময় পুলিশ নিজে তদন্ত করে। যাঁরা জেলায় কাজ করছেন সন্ত্রাস এড়ানোর দায়িত্ব তাঁদের। আমার দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা করা।’
পাশাপাশি পুনর্নির্বাচন শনিবার রাজীব সিনহা বলেছিলেন, ‘নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে নাকি অশান্ত তা বলার মতো সময় এখনও আসেনি। এর জন্য় বিস্তারিত রিপোর্টের প্রয়োজন রয়েছে। তবে কিছু জায়গা থেকে অভিযোগ এসেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখা হবে। যাচাই করে প্রয়োজনে পুনর্নির্বাচন হবে।’ এরপরই রবিবার বিকেলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে জানানো হয়, কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ ২৪ পরগনা সহ একাধিক জায়গায় পুনর্নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
কমিশন সূত্রে খবর, বারুইপুর মহকুমার জয়নগর ১ জয়নগর ২ কুলতুলি ব্লকের একাধিক বুথ ও বারুইপুরের একটি বুথে পুননির্বাচন হবে। যদিও লক্ষ্যনীয়ভাবে ভাঙড়ের কোনও বুথে পুনর্নির্বাচন হবে না। দক্ষিণ ২৪ পরগনা বারুইপুর সাবডিভিশনের অধীনে ১২ টি বুথে আবারও নতুন করে ভোট হবে সোমবার। এর মধ্যে বারুপুর থানা এলাকার বেগমপুর গ্রাম পঞ্চায়েত ৫৩ নম্বর বুথে ভোট হচ্ছে। কুলতলি জালাবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ৯০ ১৩৬ ও ১৩৭ নম্বর বুথে। এর মধ্যে জয়নগর ১ নম্বর ব্লকের রাজাপুর করাবগে গ্রাম পঞ্চায়েত ৫৬ নম্বর বুথ যা ভোট হবে বাঁটরা এফ পি স্কুলে। বহুরু ক্রেত গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮০/১, ৮০/২, ৮১ , ৮৮ নম্বর বুথে যার ভোট কেন্দ্র হাছিমপুর এফ পি স্কুলে অন্যটি তাজপুর এফ পি স্কুলে। জয়নগর দু’নম্বর ব্লক এ ময়দা অঞ্চলের তিনটি বুথে আবারও নতুন করে ভোট হবে। যার মধ্যে ৯৪, ৯৬, ৯৭ ভোট কেন্দ্র বাটরা স্কুলে।
সব মিলিয়ে বারুইপুর সাব ডিভিশন এলাকায় এলাকার এই যে বারোটি বুথে নতুন করে নির্বাচন হবে তা সুষ্ঠু এবং অবাধ ভোট করতে বদ্ধপরিকর রাজ্য নির্বাচন কমিশন। যদিও পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার একাধিক কেন্দ্রে অশান্তির ঘটনা ঘটে। সকালেই ভাঙড়ে এক আইএসএফ এবং এক তৃণমূল কর্মীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে। এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বাসন্তী এলাকার ফুল মালঞ্চ গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০৩ নম্বর বুথে, ফুল মালঞ্চ প্রাথমিক স্কুলের বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় এক স্থানীয় ব্যক্তির। পঞ্চায়েতের ১০৩ নম্বর বুথে ফুল মালঞ্চ প্রাথমিক স্কুলের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। ঘটনার পরেই বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয় এলাকায়।
নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, পূর্ব মেদিনীপুরের ৩১টি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ৩৬টি বুথে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের যে বুথগুলিতে ফের ভোট হবে তার মধ্যে নন্দীগ্রামেরও দুটি বুথ রয়েছে। এ ছাড়াও উত্তর দিনাজপুরের ৩৯টি বুথ, পশ্চিম মেদিনীপুরের ১০টি, হাওড়ায় ৮টি বুথে পুনরায় ভোট হবে। ভোট হবে পুরুলিয়ার চার ব্লকের ৪ টি বুথে, বাঁকুড়ায় ৮ বুথে ফের ভোটগ্রহণ। এছাড়া বীরভূমের ১৪ টি কেন্দ্রে, ৪২টি আসনেও হবে পুনর্নির্বাচন।
এদিকে ভোট চলাকালীন সবথেকে বেশি উত্তপ্ত ছিল মুর্শিদাবাদ। সূত্রের খবর, মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোট ১৭৫টি বুথে পুনর্নির্বাচনের জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন করাতে হবে, এই নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। কিন্তু, বাহিনী নিয়ে ভোটের আগে থেকেই তরজা শুরু হয়। এমনকী, ভোট ফুরিয়েও সেই তরজা অব্যাহত থাকে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতে, কিছু জায়গায় যে গোলমালের চিত্র দেখা গেল তার দায় জেলা প্রশাসন এবং বাহিনীর অভাবের। আরও আগে বাহিনী দিলে সুবিধা হত বলে দাবি করেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা।
এদিকে ভোটে ‘হিংসা’ হয়েছে, এই দাবিকে সামনে রেখে সুর চড়িয়েছে বিরোধী শিবির। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখেছেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। যদিও বিরোধীদের পালটা নিশানা করেছে তৃণমূল। পঞ্চায়েতে মৃত্যুর ৬০ শতাংশ তৃণমূল কর্মী, দাবি শাসক দলের। প্রসঙ্গত, ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে মোট ৬০ হাজার ৫৯৩টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হয় শনিবার। কোচবিহার থেকে মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর থেকে হুগলি একাধিক জায়গায় বোমাবাজি, গুলি চালনা, ব্যালট লুঠ, ছাপ্পা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ১৮ জনেরও বেশি ব্যক্তি প্রাণ হারান একদিনের নির্বাচনে।