বইমেলায় ব্রাত্য বাংলাদেশ, বিষন্ন বইপ্রেমীরা 

করুণাময়ী বইমেলা প্রাঙ্গণে  অর্থাৎ সেন্ট্রাল পার্কে চলছে বইয়ের উৎসব। বইয়ের এই উৎসব একেবারে শেষ লগ্নে। সাকুল্যে হাতে আর মাত্র দুটো দিন। শনি আর রবিবার। তবে ২৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় রোজই বেলা ১২টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত নেমেছে মানুষের ঢল। যার ব্যতিক্রম ছিল না শুক্রবারেও। ১৯৮৩-তে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা হিসেবে স্বীকৃত হয় এই বইমেলা। সেই সময় পুরো পৃথিবীতেই আন্তর্জাতিক মানের বইমেলা সংখ্যায় অনেক কম ছিল। ভারতে মাত্র দুটো জায়গায় আন্তর্জাতিক বইমেলা শুরু হয়। একটা দিল্লিতে আর অন্যটা কলকাতায়।
২০২৫-এর বইমেলায় থিম কান্ট্রি জার্মানি হলেও সবথেকে বেশি আলোচনায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ২৮ বছরের মধ্যে প্রথমবার কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণকারী দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতি বছর কলকাতা বইমেলায় স্টল দিচ্ছে বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলি। ২০২৪-এর মধ্যভাগে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও পরবর্তীকালে সংখ্যালঘুদর উপর অত্যাচারের অভিযোগ আসার পরেই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর প্রভাব পড়ে ভীষণভাবেই। এদিকে এবার বাংলাদেশ হাইকমিশন বইমেলায় স্টল দেওয়ার ব্যাপারে কোনও উৎসাহও দেখায়নি। এদিকে প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় ভিড়ে জমজমাট হয়ে থাকে এই প্যাভিলিয়ন। বহু মানুষ আসেন বাংলাদেশের লেখকদের বই সংগ্রহ করতে। পাশাপাশি লেখককেও সামনে থেকে দেখার লোভও ছাড়তে পারেন না বইপ্রেমীরা। তবে এ বছর সেই চেনা দৃশ্য উধাও। কারণ, রাজনৈতিক কাঁটাতারে আটকে গিয়েছে ৪৮ তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিষন্ন বইপ্রেমীদের বড় এক অংশ।
কলকাতা বইমেলায় অংশ না-নিলেও বাংলাদেশের বহু লেখক ও বহু প্রকাশনা সংস্থা’র বই এবছর প্রকাশ পেয়েছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়। এরমধ্যে অন্যতম হল অভিযান পাবলিশার্স । বাংলাদেশের প্রায় ১০টা বই এ’বছর প্রকাশ পেয়েছে এই পাবিলশার্সের হাত ধরে। আর এই বই প্রকাশ নিয়ে ‘অভিযান’ পাবলিশার্সের মারুফ হোসেন যে চাপা এক আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন না তাও নয়। আর তা তিনি স্বীকার করেছেন নিজের মুখেই। তবে সময় যত গেছে এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছেন মারুফ। কারণ,বহু মানুষ আসছেন, বই কিনছেন । ভালোই সাড়া পেয়েছেন তিনি। শুধু অভিযান নয়, ‘প্রতিভাস’-এও ভিড় জমাতে দেখা গেছে বহু বইপ্রেমী। প্রতিভাসের চিত্রার্পিতা সাহা জানান, ‘মানুষ বাংলাদেশের বই নয়, মূলত দেখছেন সূচিপত্র । তারপরেই বহু মানুষ কিনছেন। মোট ৫টা বই এবছর প্রকাশিত হয়েছে। সব বইয়ের চাহিদা রয়েছে।’
এবছর বইমেলায় প্রথম অংশগ্রহণ করেছে শান্তিনিকেতনে প্রকাশক সংস্থা ডুংরি । তারাও বাংলাদেশ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছে । যা পূর্ব বাংলার ইতিহাসের গল্প বলে । প্রকাশনী সংস্থার সদস্য শুভ নাথ জানান, ‘এই বইটা ৫০ বছর আগে একবার প্রকাশিত হয়েছিল। এবার ভারত থেকে আমরা প্রকাশ করলাম। ইতিমধ্যেই বইটার সাডা পড়েছে । ওপার বাংলা থেকেও প্রায় ৫০টির বেশি অর্ডার আমাদের কাছে এসেছে।’
প্রকাশক সংস্থা চাইলেও বইপ্রেমীরা কতটা চাইছেন বাংলাদেশকে  তা নিয়ে প্রশ্ন একটা ছিলই। তবে বইপ্রেমীদের অধিকাংশের বক্তব্য, ভারত এবং বাংলাদেশের একটা সুসর্ম্পক ছিল। যা গত কয়েক মাসে বেশ তলানিতে ঠেকেছে। তবে দু-দেশের এই সম্পর্কে রাজনীতিকে সরিয়ে শিল্প এবং সাহিত্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলেই মনে করছেন অনেকেই।
২০২৫-এর বইমেলা প্রাঙ্গনে শুধু যে যুবারা ভিড় জমিয়েছিলেন তা নয়। এই ভিড়ে নজরে আসে প্রবীণদেরও। যাঁরা সাক্ষী থেকেছেন ময়দানের বইমেলার। এরপর সেই বইমেলাই ধীরে ধীরে মিলন মেলা প্রাঙ্গন হয়ে উঠে এসেছে করুণাময়ীতে। মিলন মেলা প্রাঙ্গনে বইমেলায় পা রাখলেও প্রতি মহূর্তে উস্কে দিয়েছে ময়দানের সেই বইমেলার ছবিটা। কারণ, ময়দানের বইমেলার সেই নস্ট্যালজিয়া এখনও এঁদের তাড়া করে বেড়ায়। যতই হোক না কেন, ময়দানের বইমেলার ধুলোতে বইয়ের যে গন্ধটা ছড়িয়ে পড়তো স্টল থেকে স্টলে, তার যেন বড় অভাব করুণাময়ীর এই প্রাঙ্গনে। আর সেই ঘ্রাণ বইপ্রেমীদের হাত ধরে পৌঁছে যেতো শহরের নানা প্রান্ত থেকে অজানা কোনও গাঁয়েও। শুধু কী তাই, এই বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও কত স্মৃতি, যা সময়ের সঙ্গে কিছুটা হলেও বিবর্ণ। কত স্বপ্নের ঝড় ওঠে এই বইমেলা চত্বরে,যা আজ ঢাকা পড়েছে বইমেলার ধুলোয়। কতজন এলো গেল কতজন আসবে, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা আজও থেকে গেছে তার স্বমহিমায়। সময়ের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে একটু একটু করে প্রতিবারই নিজেকে বদলেছে এই মেলা। বইমেলার এই সমকালীন হয়ে ওঠার চেষ্টা যেমন চলছে, তেমন চলবেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − two =

preload imagepreload image