মধ্যবিত্ত বাঙালির নস্ট্যালজিয়া বাপুজি কেক হার মানায় নামীদামি বেকারিকেও

 

শুভাশিস বিশ্বাস

 

 

সামনেই বড়দিন। সর্বত্র উৎসবের আমেজ। শীত পড়তেই ফিরেছে কেকের পসরা। জমে উঠেছে কেকের বাজার। তবে বড় বড় সংস্থার কেকের বাজারের হাল ফিরলেও ছোট ছোট বেকারিগুলি ভীষণই রুগ্ন। কোনওভাবে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে এক লড়াই চালাচ্ছে তারা। এদিকে মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কায় কেকের কাঁচামালের দাম এখন আকাশছোঁয়া। তার মধ্যেও এতটুকু চাহিদা কমেনি বাপুজি কেকের। এই বাপুজি কেকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির নস্টালজিয়া।  ছেলেবেলার স্মৃতি-মাখা স্কুলের টিফিনের কত স্মৃতি। শুধু স্কুলের টিফিনেই নয়, বিকেলের অল্প খিদে মেটাতে সস্তায় পুষ্টিকর কেক মানে আম বাঙালির কাছে এখনও সেই বাপুজি। সাত থেকে আটের দশকে যাঁদের জন্ম, তাঁরা জানেন স্বাধীনতা দিবস বা স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সর্বক্ষেত্রেই ভরসা ছিল এই বাপুজি কেক। এই ছবিটা কিন্তু আজও বদলায়নি মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে। এখনও সক্কাল সক্কাল পাড়ার চায়ের দোকানে কান পাতলে শোনা যায়, ‘দাদা, একটা চা’। এরপর কাচের বয়াম থেকে পাতলা তেলতেলে কাগজে মোড়া একটা কেক বের করে নিয়ে সকালটা শুরু করেন অনেকেই। আজও বাঙালির খাদ্য তালিকায় সগর্বে বিরাজ করছে এই বাপুজি কেক। আর ঠিক এই ভাবেই দেখতে দেখতে ৫০ বছর পারও করে ফেলল এই বাপুজি কেক।

তবে এই কেকের ইতিহাস বেশ অবাক করার মতোই। বাংলায় বাপুজি কেকের পথ চলা শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। ওই বছর আলোকেশ জানা প্রথম ‘নিউ হওড়া বেকারি প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে নিজের সংস্থার রেজিস্ট্রেশন করেন। নামে।প্রথম ইউনিট খোলেন হাওড়ার পল্লব পুকুর এলাকায়। হাওড়ার পাশাপাশি শ্রীরামপুর ও লেকটাউনেও শুরু হয় নতুন ফ্যাক্টারি! যেখানে তৈরি হতে শুরু করে বাঙালির সাধের বাপুজি কেক। ভাল কেক বানানোই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য! তবে এই কেক তৈরির সময় সব থেকে বেশি নজরে রাখা হয়েছিল পড়ুয়াদের কথা। চট জলদি টিফিনের কথা মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছিল এই কেক। এখনও বাজারে বাপুজি কেক মূলত মধ্যবিত্ত বাঙালির পকেটসই দামের বিশেষ ধরনের ফ্রুট কেক। এরপর অনেক কেক তৈরি হলেও বাপুজির জায়গা কেউ নিতে পারেনি। কলকাতা যত আধুনিক হোক না কেন! এই কেক সবার প্রিয়। এমকি সেলেবরাও পছন্দ করেন বাপুজি কেক। এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখা ভাল, প্রতিদিন এই কেক ৫০ হাজারেরও বেশি বিক্রি হয়। আর এভাবেই বাঙালির ব্যবহারিক প্রয়োগে টিফিন কেক বলতে বাপুজি শব্দটি অনায়াসে জায়গা করেও নিয়েছে।

এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা অলোকেশ জানার দুই ছেলে অমিতাভ জানা এবং অনিমেষ জানা এখন বাপুজি কেকের ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। বড়দিনের জন্য বিশেষ ধরনের ফ্রুট কেক এনেছে বাপুজি। তবে টিফিন কেকের দাম বাড়ায়নি সংস্থা। না মোড়কের জৌলুস ছিল বা আছে, না স্বাদে এসেছে কোনও রকম পরিবর্তন। তবুও হাজারও নামী-দামি কেকের ভিড়ে এখনও বাঙালির মনে পাকা জায়গা করে নিয়েছে বাপুজি কেক। আর এই প্রসঙ্গে বাপুজি কেকের বর্তমান কর্ণধাররা জানাচ্ছেন, বাপুজি কেকের স্বাদ,দাম,মান সবকিছুই প্রধান ইউএসপি। আর একটি ইউএসপি হল এর কাগজে মোড়া প্যাকেট। পরবর্তী কালে জনপ্রিয়তা বাড়তে এবং ব্যবসার খাতিরে  কোম্পানি বাপুজি কেকের পাশাপাশি বিভিন্ন বিস্কুট ও পাউরুটির প্রোডাকশনের কথাও ভেবেছে। সেই থেকেই বাজারে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট এবং পাউরুটিও বাপুজির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে।

পাশাপাশি তাঁরা এও জানান, বেকারিতে মেশিনের ব্যবহার আছে ঠিকই, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনও এই কেক প্রস্তুতি সম্পূর্ণভাবে হাতে করা হয়। মাঝে নোট বাতিলের সময় বেশ কিছুদিনের জন্য বাজার থেকে হারিয়ে গিয়েছিল বাঙালির প্রিয় বাপুজি। মাত্র কটা দিনেই ক্রেতাদের চাহিদা বাপুজির জনপ্রিয়তা চিনিয়ে দেয়। তবে বড় সমস্যার ব্যাপার হল, বাজারে একাধিক কোম্পানি বাপুজি নাম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে টিফিন কেকের ব্যবসা শুরু করেছে। বর্তমানে রংচঙে নামী কোম্পানির প্যাকেটের পাশে বাপুজি কেকের একঘেয়ে সেই পুরনো কাগজের মোড়ক, ক্রেতাদের নজর কাড়তে পারে না ঠিকই, কিন্তু দূষণ আটকাতে অবশ্যই পারে। পরিবেশ-বান্ধব এই ব্যবস্থার অভিনবত্ব সেখানেই। সারা দেশ বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে, আর তার এত বছর আগে থেকেই এই কেক কোম্পানি চোখে আঙুল দিয়ে বিরোধিতা করে চলেছে প্লাস্টিক ব্যবহারের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 − five =