বিজেপির প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হল না বাজেটে

বিজেপির নির্বাচনে বিজেপির তরফ থেকে একগাদা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এদিকে ২৩ জুলাই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ যে বাজেট পেশ করলেন তাতে সেই প্রতিশ্রুতি পালনের কোনও সদিচ্ছাই দেখা যায়নি। কারণ, দেশের উন্নতিতে দরকার কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, শিল্পের উন্নতি। জিডিপি-র বৃদ্ধি অর্থনৈতিক বিকাশের সূচক হলেও উন্নয়নের নির্দেশক নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও কিছু দাবি করে। তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আয়ের সুষম বণ্টন। ২০২৩ সালের শেষে দেখা গেছে বর্তমান ভারতে ১ শতাংশ ধনী লোকের হাতে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। আর উল্টোদিকে দেশের ৫০ শতাংশ জনগণের হাতে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। আয়ের এই বৈষম্য ক্রমশ বেড়েছে। কিন্তু দেশের উন্নতিতে এটা কমানো জরুরি। যে কোনও দেশের উন্নয়ন ঘটাতে গেলে আরও দুটি বিষয়ের ওপর নজর দেওয়া বিশেষ জরুরি। যার মধ্যে একটি হল দারিদ্র্য দূরীকরণ ও দ্বিতীয়টি হল কাজের সুযোগ তৈরি করা। ভারতে এই মুহূর্তে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির হার কম-বেশি ৮.৭০ শতাংশ হয়ে আছে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের দুর্দশা সবচেয়ে বেশি। খাদ্যের সংস্থান করতে নাভিশ্বাস ওঠে। এই আবহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মহিলাদের ক্ষমতায়ন। এর সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে তাকেও অবহেলা করা যায় না। সঙ্গে রয়েছে জলবায়ুর ফ্য়াক্টরও। যা এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। ভারতকেও এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর বাইরেও রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য বিষয়।

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ সংসদে মোদি-৩ সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করেছেন গত ২৩ জুলাই। এবারের পরিস্থিতি গতবারের তুলনায় আলাদা। গত বাজেট ছিল নির্বাচনমুখি, ফলে জনগণকে খুশি করার একটা বাধ্যবাধকতা থেকে গিয়েছিল। সবে নির্বাচন শেষ হয়ে দেশে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আশা ছিল দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অর্থমন্ত্রী কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেবেন।

বাজেটে তা নজরে আসেনি। যা হল, কিছু কথার কারিকুরি আর সরকার বাঁচানোর মরিয়া প্রচেষ্টা। মোদি-৩ সরকারের অক্সিজেন নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডুকে খুশি করতে বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বাজেটে দেওয়া হল ঢালাও সুযোগসুবিধা। অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করতে গিয়ে বলেন, ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’-এর স্বপ্ন পূরণ করতে সরকার নয়টি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে কৃষি, কর্মসংস্থান, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, উত্পাদন এবং পরিষেবা, নগর উন্নয়ন, শক্তি, পরিকাঠামো, উদ্ভাবন এবং গবেষণা ও উন্নয়ন এবং পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কার। বাজেট পেশের শুরুতেই অর্থমন্ত্রী বলেন দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং খাদ্যদ্রব্যের যথেষ্ট জোগান আছে। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এ প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, তাহলে খাদ্যদ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে কেন তা নিয়ে। এ-বিষয়ে বাজেটে কোনও পরিষ্কার দিশা কিন্তু মেলেনি। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য আর বাস্তবে বিস্তর ফারাক।

নয়টি অগ্রাধিকারের প্রথমটি কৃষি। বাজেটে কৃষির বরাদ্দ হয়েছে ১ লক্ষ ৫২ হাজার কোটি। কৃষি গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং জলবায়ু-সহনশীল ফসলগুলির বিকাশের উপর নজর দিতে কৃষি-গবেষণা সেটআপের বিস্তৃত পর্যালোচনা করার কথা বলা হয়েছে। ডাল ও তৈলবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকার তাদের উৎপাদন, মজুত ও বিপণন জোরদার করবে। সরিষা, চিনাবাদাম, তিল, সয়াবিন এবং সূর্যমুখীর মতো তৈলবীজে আত্মনির্ভরতা অর্জনের জন্য একটি কৌশল তৈরি করা হচ্ছে। আগামী দু-বছরের মধ্যে সারা দেশের ১ কোটি চাষিকে প্রাকৃতিক চাষিতে রূপান্তরিত করা হবে। ফসল সংরক্ষণ, কৃষি সমবায় গঠনেও জোর দেওয়া হয়েছে। মূলত কৃষির প্রযুক্তিগত ও পরিকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দেওয়া হল।

তবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় এবারের বাজেট অধরা থেকে গেল। এক, কৃষির উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যসুরক্ষা যা এই মুহূর্তে দেশের জন্য অত্য়ন্ত জরুরি। আর তার বদলে জনগণের নজর ঘোরাতে তিনি যোগ করলেন ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’। যা পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হল এবং শোনালেন, এতে দেশের ৮0 কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। দুই, ফসলের সঠিক দাম নিশ্চিত করে কৃষকের আয় বৃদ্ধি। উল্টে তিনি জোরের সঙ্গে বলেন, ফসলের এমএসপি ঘোষণার কথা। আমজনতা জানে না এমএসপি নির্ধারণে হিসেবের মারপ্যাঁচের কথা। আশা ছিল স্বামীনাথন কমিটির রির্পোট অনুযায়ী এমএসপি দেওয়া হবে। কিন্তু হয়নি।

কৃষি ছাড়া আর বেশ কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিলেন অর্থমন্ত্রী। এই তালিকায় রয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য তিনটি নতুন স্কিম ঘোষণা। সরকার আগামী পাঁচ বছরে ৪ কোটি চাকরি সৃষ্টির জন্য ২ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করবে এবং ৫০০টি শীর্ষ কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ প্রদানের জন্য একটি বৃহৎ স্কিম চালু করা হয়েছে।

পরিকাঠামো উন্নয়নে সরকার ১০০টি শহরে বা কাছাকাছি অঞ্চলে শিল্প পার্ক গড়ে তুলবে। বিহারে মোট ২৬০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হবে। এছাড়াও ওই রাজ্যে বিদ্যুৎপ্রকল্প, নতুন বিমানবন্দর, মেডিকেল কলেজ এবং ক্রীড়া পরিকাঠামো নির্মাণ করা হবে।

মহিলাদের দক্ষতা বাড়াতে প্রকল্প গৃহীত হবে তার জন্য ৩ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তাদের বেশি করে কাজের বাজারে আনতে হোস্টেল ও মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করা হবে।

পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে এমএসএমই ক্রেডিটের একটি নতুন মূল্যায়ন মডেল চালু করা হয়েছে এবং এমএসএমই-গুলির জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হবে৷ স্ব-রোজগার প্রকল্পকে উৎসাহ দিতে ‘মুদ্রা যোজনা’-র অধীনে ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ করে ২০ লক্ষ টাকা করা হবে।

যে-সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা এখনও কোনও সরকারি স্কিম থেকে উপকৃত হয়নি তারা গার্হস্থ্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার জন্য ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সহায়তা ঋণ পাবে। প্রতি বছর ১ লক্ষ শিক্ষার্থীকে ঋণের পরিমাণের উপর ৩ শতাংশ সুদ ছাড়ের ই-ভাউচারগুলি সরাসরি প্রদান করা হবে।

২০২৫ অর্থিক বছরের জন্য রাজস্ব ঘাটতির লক্ষ্য স্থির হয়েছে জিডিপি-র ৪.৯ শতাংশ, পরের বছর এটিকে ৪.৫ শতাংশের নিচে নামানো হবে।

মূলধন লাভের কর আরোপ করা হবে যুক্তিযুক্ত এবং সরলীকৃত। স্বল্পমেয়াদি মূলধন লাভের উপর ২০ শতাংশ কর ধার্য করা হবে, এবং কিছু সম্পত্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদি মূলধন লাভের উপর ১২.৫ শতাংশ কর ধার্য করা হবে।

মধ্যবিত্তদের সাহায্য করার জন্য আয়কর আইন ১৯৬১-র একটি ব্যাপক পর্যালোচনা করা হবে। নতুন ব্যবস্থার অধীনে ট্যাক্স স্ল্যাবগুলি সংশোধন করা হয়েছে এবং বেতনভোগী কর্মচারীদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন ৫০০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫০০০ টাকা করা হয়েছে।

এখনও পর্যন্ত এই বাজেটে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের আয় বাড়ানোর কোনও দিশা নেই। ট্যাক্স-কাঠামোতে একটু সাহসী পরিবর্তন করতে পারলে অর্থনীতির অনেকটা উপকার হত। উচ্চ আয়সম্পন্ন মানুষ যারা আয়কর দেওয়ার নিরিখে উপরের দিকে অবস্থান করেন তাঁদের আয়করের হার একটু বাড়িয়ে, তুলনায় কম আয়ের মানুষ যারা আয়কর দেন, তাঁদের আয়করের ছাড় একটু বেশি দিলে আয়-বৈষম্য কিছুটা কমানো যেত। কম আয়কর দেওয়া মানুষ একটু বেশি ছাড় পেলে অর্থনীতিতে কার্যকরী চাহিদা অনেকটা বাড়ে। তার মূল কারণ এই মানুষদের ভোগপ্রবণতা উচ্চবিত্তের ভোগপ্রবণতার চেয়ে অনেক বেশি। করদাতাদের সম্মান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যদি স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশনে মাত্র ২৫০০০ টাকার ছাড় হয় তাহলে বলার কিছু নেই! এই ছাড় অর্থনীতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। ফলে এই বাজেটে সাধারণের আয় বাড়ানোর যেমন দিশা নেই তেমন নেই খাদ্যদ্রব্যের দাম কমানোরও। ভারতে প্রতিটি পরিবার তাদের আয়ের ৫০ শতাংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে। দরিদ্র জনগণের ক্ষেত্রে তা ৬০ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষ তাঁদের আয়ের বেশি অংশ যদি খাদ্যদ্রব্য কিনতেই ব্যয় করেন তাহলে শিল্পদ্রব্যের চাহিদা আসবে কোথা থেকে তা নিয়েও থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি শিল্পদ্রব্যের কার্যকরী চাহিদাকে কমিয়ে দেয়। কৃষির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন প্রায় ৪৩ শতাংশ মানুষ। ফলে অর্থনীতির কার্যকরী চাহিদার অনেকটাই কৃষিনির্ভর। কৃষকের আর্থিক অনটন বাজার অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই বাজেটে কৃষকদের আয়ের দিকটিও অবহেলিত থেকেছে। কার্যকরী চাহিদার এই ঘাটতি শিল্পে বিনিয়োগ কমাবে। কমিয়ে দেবে কর্মসংস্থান। অধরা থেকে যাবে জিডিপি বৃদ্ধির স্বপ্নও।

এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা না বললেই নয়। তা হল, জিডিপির বৃদ্ধি ঘটিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করতে হলে দরকার পরিকাঠামোর উন্নয়ন। প্রয়োজন মূলধনী ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো। কিন্তু এবারের বাজেটে আশানুরূপ কোনও বৃদ্ধি-ই নজরে আসেনি। যদিও সংখ্যার বিচারে বেড়েছে। যা গতবারের তুলনায় মাত্র ১১ শতাংশ বেশি। গত বাজেটে মূলধনী খাতে ব্যয় বেড়েছিল ২০২২-২৩ সালের তুলনায় ৩৭.৪ শতাংশ। এদিকে বাজেটে খাদ্যদ্রব্যের দাম কমানোর কোনও ইঙ্গিত নেই। ফলে এ বাজেটে আম-জনতা থেকে গেলেন সেই অন্ধকারেই।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six − 5 =