মানব আচরণের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া। যেখানে সেরোটনিন ও ডোপামাইন,এই দুটি রাসায়নিক মনের চাপে একই সাথে কাজ করে। খুব সহজ ভাষায় বললে এই দুটি হল হরমোন। তবে এই দুটির মধ্যে একটা অদ্ভুত যোগাযোগও রযেছে যেমন, সেরোটনিন বাড়লে ডোপামাইন কমে। আর তার ঠিক উল্টো ব্যাপারটা হল, সেরোটনিন কমলে ডোপামাইন বাড়ে।আর এই সেরোটনিন ও ডোপামাইন নামে এই দুটি রাসায়নিক বা হরমোন মনের চাপে একই সাথে কাজ করে।
এখন কথা হল সেরোটনিন কী?
সেরোটোনিন একধরনের নিউরোট্রান্সমিটার। নিউরোট্রান্সমিটার হল একধরনের সিগন্যালিং কেমিক্যাল, যার মাধ্যমে একটি নিউরন অন্য নিউরনের সঙ্গে কমিউনিকেট করে। নিউরন হলো স্নায়ু সিগন্যাল পাঠানোর কোষ। মানুষের শরীরে এমন ১০০টির বেশি নিউরোট্রান্সমিটার আছে, যারা এই স্নায়ুবিক সংকেতগুলো একস্নায়ুকোষ থেকে আরেকটিকে নিয়ে যায়। একটু বললে সেরোটোনিন হলো মনোএমাইন ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যাদের মধ্যে অ্যামিনো আছে।
আর এই সেরোটোনিনের কেমিক্যাল নাম ট্রিপ্টামিন। ঠিকমতো বললে ৫-Hydroxytryptamine । সেরোটোনিনের অনেক কাজ। প্রধান কাজ অন্ত্রে, বাকি কাজ মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কে মুড, মেমোরি, লার্নিং প্রসেসে সেরোটোনিন কাজ করে। আমাদের মুড হরমোন। কিন্তু সেরোটোনিনের শুধু একটি কাজ নয়। মস্তিষ্কে সে এক কাজ করলে শরীরের আরেক জায়গায় সে আরেক কাজ করে। রক্তে জমাট বাঁধায়, পেটে খাদ্যনালীকে চালায়, খাদ্য পরিপাকে সাহাঘ্য করে, লিভারে পুষ্টি পরিপাকে সাহায্য করে, হাড়ের গঠনে সাহায্য করে, রক্তনালীকে নিয়ন্ত্রণ করে। পুরো শরীরেই সেরোটোনিনের কাজ আছে। শরীরে সেরোটোনিন বেশি কমে গেলেও সমস্যা, আবার বেশি বেড়ে গেলেও সমস্যা আছে। মস্তিষ্কে সেরোটোনিন একটি মাত্রার চেয়ে কমে গেলে ডিপ্রেসেড লাগে, বেশি বেড়ে গেলে অন্ত্রের স্নায়ুবিক এফেক্ট বেড়ে যায়। এতে রক্ত চাপ বেড়ে যেতে পারে, শরীর ঘামাতে থাকে, মাথা ব্যথা বেড়ে যায়। আবার মস্তিষ্কে বেশি মাত্রায় সেরোটোনিন বেড়ে গেলে যৌনতা বোধ কমে যায়। রক্তে স্বাভাবিক মাত্রার সেরোটোনিন লেভেল ০১–২৮৩ ng/ml। খুব বেশি মাত্রার সেরোটোনিনের উপস্থিতি কার্সিনোয়েড সিনড্রোমের সিম্পটম। এদিকে ডোপামাইন হরমোন মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে উৎপন্ন এমন এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার বা রাসায়নিক বার্তাবাহক যা অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটার এর মতো স্নায়ু কোষের মধ্যকার যোগাযোগ রক্ষা করে এবং নার্ভ এর মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অংশে তথ্য আদান প্রদানের কাজ করে থাকে। এটি মানুষের আনন্দের অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। যখন আমাদের কোনো কিছু ভালো লাগে তখন মস্তিষ্ক ডোপামাইন ক্ষরণ করে যা আনন্দের অনুভূতিকে বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে ঐ কাজটি আমরা পুনরায় করার আগ্রহ বোধ করি। ডোপামাইন এর অপর নাম ‘Feel Good Chemical’. কারণ এর প্রভাবে আমাদের আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়। এটি আমাদের মনে যে উদ্দীপনা তৈরি করে তাকে Reward Motivation Effect বলে।
এখানে আরও একটা কথা বলে রাখা দরকার। তা হল, আগে মানুষের ধারণা ছিল এই রাসায়নিকগুলি জন্ম থেকেই একই থাকে। এরপর গবেষণায় মানুষের চাপের পরিবর্তন লক্ষ্য করে তাদের আলাদা আলাদা ভাবে গোষ্ঠীভুক্ত করে তাদের সেরোটনিন পরীক্ষা করা হয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক চাপে সেরোটনিনের বাড়া বা কমা হয়। আর এই সেরোটোনিন বা ডোপামাইন কম বেশি থাকার কারণে সকল শারীরিক , মানসিক ও সামাজিক সমস্যার শুরু। শুধু তাই নয়, এটি সাইকোট্রপিক ওষুধের নির্বাচনকেও তুলে ধরে।
এই প্রসঙ্গে এটাও বলে রাখা শ্রেয়, কারও যদি মনঃসংযোগে সমস্যা হয়, অবসন্ন লাগে, কাজের ইচ্ছে চলে যায়, ধরে নেওয়া হয় ব্রেনে ডোপামাইনের মাত্রা কমে গিয়েছে। সেরোটোনিনের নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি। যেমন, হাল ছেড়ে দেওয়া, অপরাধবোধে ভোগা, আত্মহত্যার প্রবণতা এমন নানা ধরনের উপসর্গ দেখা যায় সেরোটোনিনের মাত্রার হেরফেরে। এর প্রকাশও অনেক বেশি। ঘুমের সাইকল বিঘ্নিত হওয়া, যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়াও এর অন্যতম উপসর্গ।
এদিকে ডোপামাইন মোটিভেশন, মনঃসংযোগ, ইমপালসিভিটি বাড়ায়। টিনএজাররা আবেগপ্রবণ হয়, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে সিদ্ধান্ত নেয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বিবেচনা বোধ, কিন্তু ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কমে। ডোপামাইন এগুলির নিয়ন্ত্রক। ঝিমিয়ে থাকা ব্রেনকে চনমনে করে তোলার জন্য নিকোটিন, ক্যাফিনের সাহায্য নেয় কেউ কেউ, যা স্টিমুলেট করে ডোপামিনের ক্ষরণ।
তবে এই ব্যাপারে খুশির খবর দিলেন ডক্টর দেবাশিস ঘোষ। তিনি জানান, ‘এখন রক্তে প্লেটিলেট সেরোটনিনের মাত্রা বিশিষ্ট পদ্ধতিতে ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারা যাচ্ছে। আর এই রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের মানসিক চাপ বোঝা যায়। যেখানে চিকিৎসকেরা সঠিক চিকিৎসা বেছে নিতে পারবেন ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ কম ব্যবহার করতে হবে।’