কেক আর নাহুমস, বড়দিনে শব্দ দুটি এখনও সমার্থক

শুভাশিস বিশ্বাস

 

কেক আর নাহুমস, বড়দিনে এই দুটো সমার্থক শব্দ কলকাতাবাসীর কাছে। নিউ মার্কেটের এই দোকানটি শহরের হেরিটেজের সঙ্গে পরতে পরতে যেন মিশে গেছে। নিউ মার্কেটের ভিতরে একটু এগোলেই দূর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধের আবেশ। আরও খানিকটা এগিয়ে কাচ ঘেরা এক দোকান। জৌলুস বিশেষ নেই।তবে পুরনো ধাঁচটাই এর বিশেষত্ব বলা যায়। ১২১ বছরের পুরনো হলেও, আভিজাত্যে এখনও ভরপুর এটি। কালো সেগুন কাঠের আসবাব। শো-কেসের পালিশেও বেশ সাবেকি ছোঁয়া। জিঙ্ক প্যানেলের ইতালিয়ান ডেকরেটিভ সিলিং। মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে নামের প্ল্যাকার্ডটা। নাহুম অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড। ভেতরে ঢুকলেই নজরে পড়বে কেক, পেস্ট্রি, চিজ, কেক। তবে এই দোকানের কেকে শুধু ইতিহাস মাখানোই নয়, রয়েছে সম্প্রীতির সুবাসও। এখানে কেকের কারিগররা মুসলিম, দোকানের মালিক ইহুদি,যাঁরা খ্রিষ্টান ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসবকে লক্ষ্য করে বিশেষ ধরনের কেক বিক্রি করেন।

এই নাহুমসের সূত্রপাত ১৯০২ সালে। নাহুম ইজরায়েল মরদেকাই নামের এক ইহুদির হাতে গড়ে ওঠে এই বেকারি। শুরুর দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেকে পেস্ট্রি বিক্রি করতেন। পরে ১৯১৬ সালে নিউ মার্কেটে শুরু করেন নিজের দোকান। আজও যে দোকান স্বমহিমায় বিরাজমান। বয়সে বৃদ্ধ হলেও এখনও ভেঙে পড়েনি নাহুমস। সেই পুরনো সময়ের মতো এখনও রমরমিয়ে চলছে।এদিকে যত দিন যাচ্ছে শহর কলকাতায় তৈরি হচ্ছে একের পর এক বেকারি। সেখানে লোকে ভিড়ও জমাচ্ছেন ঠিকই তবে তাতে বিশেষ প্রভাব পড়েনি নাহুমসের ওপর। এতো কিছুর মাঝেও নিজের জায়গা ঠিক ধরে রেখেছে নাহুমস।

এদিকে বড়দিনে বাঙালি একবার হলেও পা রাখেন এই নাহুমসে। কলকাতাবাসীর কাছে যেন বড়দিনের অপর একটা নাম এই নাহুমস। কেক থেকে প্যাটিস বিস্কুট থেকে কুকিস প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ রকমের সম্ভার নিয়ে কলকাতাবাসীর মন জয় করেছে সুবিশাল এই কেকশপ। হিন্দু,মুসলিম, পার্সি কিংবা মাড়োয়ারি মনপসন্দ কেকের হদিস পেতে সকলেই ভিড় জমান এই কেকশপে। কলকাতার বিখ্যাত গলি হগ মার্কেটে রমরমিয়ে চলে নাহুম পরিবারের ব্যবসা। ক্রেতাদের অনেকেই জানিয়েছেন, এই শপের প্রধান আকর্ষণ চকলেট, স্ট্রবেরি কেক কিংবা রাম বল। তবে শীতের সময় প্রধানত বড়দিন এবং নতুন বছরে ক্রেতাদের চোখের মণি হয়ে ওঠে রিচ ফ্রুট কেক। তাদের রিচ ফ্রুট কেকের মধ্যেও রয়েছে স্পেশালিটি। শীতে চাহিদার তুঙ্গে থাকে নাহুমস স্পেশাল পুডিং। বিকেলে গরম পুডিং হাতে নিয়ে লোভ সামলানো বেশ কঠিন।  এছাড়াও সবসময়ের জন্যই রয়েছে ব্রাটুনি, ব্ল্যাক ফরেস্ট, ক্রুজের মতো নানা কেক ও পেস্ট্রির সম্ভার । আগের চেয়ে এখন অনেক নতুন ধরণের কেক তৈরি করছেন এঁরা। ফলে স্টক বেড়েছে। যেমন নতুন সংযোজন বিস্কুট। হাতে তৈরি এই বিস্কুট প্যাকেট এর পর প্যাকেট সেজেগুজে তৈরি হয়ে রয়েছে এই দোকানে।

কেক তৈরির এই সংস্থার তরফ থেকে এও জানানো হয়, এক শতাব্দী আগে যে পদ্ধতি এবং রেসিপি ব্যবহার করা হতো কেক তৈরির ক্ষেত্রে আজও তার কোনও বদল ঘটেনি। এখন নাহুমসে ৫০০ গ্রাম ওজনের ফ্রুট কেকের দাম ২০০ টাকা থেকে শুরু হয়। এরপর  গুণমান অনুযায়ী দাম বাড়তে থাকে কেকের। আর বড়দিন উপলক্ষে তো বিশেষ কেক রয়েইছে নাহুমসের তরফ থেকে। তবে কেক তৈরির ছে এই সংস্থা সাক্ষী থেকেছে বঙ্গভঙ্গ, অসহযোগ, স্বাধীনতা, দেশভাগ, নকশাল আন্দোলনের মতো বহু ঘটনার। এতো কিছুর মাঝেও শহরবাসীর সঙ্গে বড়দিনের আনন্দ আজও ভাগ করে নিচ্ছে সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 + six =