২০২৩ বলিউডের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশেষ করে অতিমারি উত্তর পর্বে। করোনাকালে ব্যবসায় যেরকম ধাক্কা খেয়েছিল দেশের বিনোদুনিয়া, তা সামলে উঠতে দু বছর সময় লেগেছে সিনেদুনিয়ার। সে বলিউড হোক কিংবা টলিউড। বাইশে বিনোদুনিয়ার বাতি টিম টিম করে জ্বললেও তেইশের প্রথমেই মাসেই বলিউডে সুসময়ের মশাল জ্বেলেছিলেন শাহরুখ খান। আর টলিপাড়ায় সেই দায়িত্ব বহন করেছেন সুপারস্টার দেব। তবে সুসময় ফিরলেও এবছর কিন্তু সিনেজঞ্জালের অন্ত নেই তা বড়পর্দায় হোক কিংবা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে।
কিছু বিগ ফ্যাট বাজেটের বহু প্রতীক্ষিত ছবি আবার বিতর্কের শিরোনামেও দাপিয়েছে। যেমন ৬০০ কোটি বাজেটের ওম রাউত পরিচালিত ‘আদিপুরুষ’। চন্দ্রযান ৩ বানাতেও এই টাকা লাগেনি! যেমন রদ্দিমার্কা সংলাপ তেমনই উপস্থাপন। আধুনিকীকরণ করার প্রচেষ্টায় রাবণের লঙ্কায় লিফট দেখানো থেকে শুরু করে লঙ্কারাজের দোতলা মাথা সম্ভবত এযাবৎকাল কোনও দর্শক কোনও সিনেমা-সিরিজে দেখেননি! উপরন্তু হনুমানের মুখে বাপ-বাপান্ত সংলাপ বসিয়ে ওম রাউত নিজেই খাল কেটে বিতর্কের কুমির বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। প্রভাস-কৃতীকেও কম অপমানিত হতে হয়নি সোশাল মিডিয়াজুড়ে।
এর পর ফেরা যাক সলমন খানের বহু প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘কিসি কা ভাই কিসি কি জান’-এর দিকে। তেইশের অন্যতম বিগ বাজেট সিনেমা। কিন্তু এতটাই খারাপ উপস্থাপন যে দেখতে গেলেও দর্শকমনে বিরক্ত ধরে! তেমনই সলমনের নাচের স্টেপ। বছরখানেক বাদে এই সিনেমা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন সলমন ভক্তরা। কিন্তু কোথায় কী? জঘন্য চিত্রনাট্য। পর্দায় ভাইজানের ইয়াব্বড় চুল আর অদ্ভূতমার্কা সংলাপ বলার ধরণ শুনে তাঁরাও তিতিবিরক্ত হয়েছে। পরে অবশ্য ‘টাইগার ৩’র সুবাদে ড্যামেজ কন্ট্রোল হয়েছে।
বিকাশ বহেল পরিচালিত ‘গণপত’ দেখা সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। টাইগার শ্রফ, কৃতী শ্যানন এবং অমিতাভ বচ্চনের মতো অভিনেতাকে কাস্ট করেও সুপারফ্লপ। ভিএফএক্স ততোধিক খারাপ। একই অবস্থা কার্তিক আরিয়ান এবং কৃতী স্যানন অভিনীত শেহজাদার। দক্ষিণী সিনেমার রিমেক হলেও চিত্রনাট্য, গল্পের বাঁধন অত্যন্ত খাঁজা! তারকাদের অভিনয়ও মাঝারি মানের।
সিনেজঞ্জালের তালিকার অন্যতম ‘দ্য ভ্যাকসিন ওয়ার’। করোনাকালে ভারতের বিজ্ঞানীদের জয়গান গাইতে গিয়ে প্রথমসারির অন্য যোদ্ধাদের যেভাবে নিচু করে দেখিয়েছেন পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী, তাতে পরিচালকের নিজেরই লজ্জা পাওয়া উচিত! প্রশ্ন উঠছে, অতিমারি যুদ্ধে মোদিবন্দনা করতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমকে কটাক্ষ করার কি খুব প্রয়োজন ছিল? প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাস্তব ঘটনা দেখানোর। কিন্তু পক্ষপাতীত্ব করতে গিয়ে মিথ্যের ঝুড়ি খুলে বসেন পরিচালক।
১৯৮৯ সালে রানিগঞ্জ কয়লাখনির দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে ভুলতে বসা অতীত মনে করাতে চেয়েছিলেন অক্ষয় কুমার। কিন্তু ‘মিশন রানিগঞ্জ’ ছবিতে অধিক মশলা প্রয়োগ করেই বাস্তব নষ্ট করে দেন অভিনেতা।
‘ইয়ারিয়া ২’ ছবিটি একেবারেই বসে দেখা যায় না। গানগুলোও শোনার মতো নয়! মালয়ালম ছবির দুরন্ত চিত্রনাট্য বলিউডের হাতে পড়ে দুর্বল। ততোধিক খারাপ দিব্যা কুমার খোসলা, মেজান জাফরি, পার্ল ভি পুরী, প্রিয়া প্রকাশ ওয়ারিয়ার, ওয়ারিনা হুসেনদের অভিনয়।
এবছরও ফ্লপ তকমা ঘোচাতে পারলেন না কঙ্গনা রানাউত! দেশপ্রেমের রানওয়েতেও মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে ‘তেজস’কে। কঙ্গনা গতানুগতিকতার জালে নিজেকে বড্ড বেশি জড়িয়ে ফেলেছেন এই ছবিতে। এই ছবি না দেখলেও কোনও ক্ষতি হবে না! বহুকাল বাদে অর্জুন কাপুরের একটা সিনেমা রিলিজ করেছে ২০২৩ সালে। কিন্তু ‘লেডি কিলার’ এতটাই খারাপ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যে এই প্রসঙ্গে কিছু না বলাই শ্রেয়।
হিন্দিভাষী ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ করা বেশ কিছু সিনেমা-সিরিজও সিনেদুনিয়ার জঞ্জাল ছাড়া আর কিচ্ছু নয়! সেই তালিকায় ‘টিকু ওয়েডস শেরু’, ‘সুখী’, ‘ধক ধক’, ‘আর্চিস’, ‘গন্দীবাত’, ‘জি করদা’, ‘আখরি সচ’, ‘টুথপরী’, ‘চার্লি চোপড়া’ উল্লেখ্য। একাধিক তারকাসন্তানদের কাস্ট করে জোয়া আখতার বছরের শেষে আর্চিস-এর মতো একটা সিরিজ বানিয়েছেন, যা দেখে নেপোপ্রোডাক্ট ছাড়া কিছুই মনে হয় না! এই সিনেমা-সিরিজগুলো মিস করে থাকলে আফশোস করার কিচ্ছু নেই। আপনার সময় বেঁচে গিয়েছে।
হিন্দি বিনোদুনিয়ার পাশাপাশি বাংলাতেও সিনেজঞ্জালের সংখ্যা একাধিক। স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষের কষ্ট-কসরত থাকে, কিন্তু গ্যাটের কড়ি খরচ করে দর্শকরা কেন এহেন সিনেমা-সিরিজ দেখে বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রির পাশে দাঁড়ান বলে ফেসবুকে লম্বা হ্যাজ নামাবে? তার যুক্তি খুঁজে পাওয়া গেলে সুবিধে হয়। ‘বিবাহ অভিযান’ প্রথম ছবিতে যতটা নজর কেড়েছিল, সিক্যুয়েলে ততোধিক খারাপ। বিশেষ করে উপস্থাপন। ঝা চকচকে স্টার কাস্ট থাকেলও শেষ পর্যন্ত ফিরতে হয়েছে একবুক হতাশা নিয়েই।
এমনিতেই বাংলা সিনেমার ভাঁড়ে মা ভবানী! হিন্দি ছবি এলে প্রতিবাদ করে প্রেক্ষাগৃহে স্লট টিকিয়ে রাখতে হয়, এমন এক অবস্থাতে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সিনেনির্মাতারা যদি সাবধান না হন, তাহলে আগামী দশ বছরেও টলিউডের হাল ফেরানো যাবে কিনা সন্দেহ। কমেডির মোড়কে ভাঁড়ামো, জোর করে হাসানোর চেষ্টা কিংবা রহস্য-রোমাঞ্চের নামে পাহাড়ে গিয়ে মাফলার-মাংকি টুপি পরে কুয়াশায় টর্চ ফেলে জোর করে দর্শকমনকে কষ্ট দেওয়া কন্টেন্ট বর্জন করলে ভালো হয়। এরকম বহু ওয়েব সিরিজ রয়েছে, যেগুলোর গল্প অত্যন্ত নিচুমানের। ‘চেঙ্গিজ’ বাণিজ্যিকভাবে সফল হলেও কন্টেন্ট ততটাই খারাপ।
এই একই বছরে জিতের মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মানুষ’ অবশ্য তুলনামূলক ভালো। কিন্তু গল্প সেই এক- দক্ষিণী রিমেক। এই মারপিট, অ্যাকশনের বাইরে গিয়েও রয়েছে গোয়েন্দা ঘরানা। বাঙালি রহস্য, রোমাঞ্চ, গোয়েন্দাগিরি ভালোবাসে ঠিকই। কিন্তু ব্যোমকেশ, ফেলুদাকে নিয়ে দড়ি টানাটানিটা বড্ড একঘেয়ে গিয়েছে এবছর! এপ্রসঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের কথা ধার করে শুধু তিনটে শব্দ- ‘ভাবা প্র্যাকটিস করুন!’
যে ছবিগুলো না তৈরি হলেও বাংলা সিনেইন্ডাস্ট্রির কিচ্ছু যেত-আসত না, সেই তালিকায়- ‘টেনিদা’- কাঞ্চনের কাস্টিং যথেষ্ট বেমানান। বইয়ের চরিত্র পর্দায় বাস্তবায়ণ করতে হলে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এই তালিকায় রয়েছে ‘রিভলবার রহস্য’, ‘পাকদণ্ডী’, ‘লাভ ম্যারেজ’, ‘দত্তা’, ‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’, ‘ওহ লাভলি’, ‘কুরবান’-এর মতো সিনেমাগুলোও।