রং এখন এক অন্য মাত্রা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির। রংয়ের বিশ্বাস আর বিশ্বাসের রং নিয়ে কাজিয়া চলছে। মনে করে দেখুন বহুদিন আগে আরএসপির যতীন চক্রবর্তী খাস কলকাতার শহীদ মিনারের চুড়োটাই লাল রংয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন। তা নিয়ে বিরাট বাওয়ালও হয়েছিল। পরবর্তীতে মমতা এসে গোটা শহরটাকেই নীল-সাদা করে দিয়েছেন। এই দুই ঘটনায় চ্যাঁচামেচি কম হয়নি।
আদি মুনি ঋষি ব্রাহ্মণদের পোশাক ছিল সাদা, হ্যাঁ সফেদ, দুগ্ধ ফেনিল সাদা, দুধের ফেনার মতো সাদা। মনে রাখবেন, চারটে বেদে কোথাও গেরুয়া রংয়ের উল্লেখ নেই। রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী কিংবা কাবায় হজ করতে যাওয়া ভক্তের দলও তো ওই সাদা কাপড়ই পরেন। বহু পরে মূলত ব্রাহ্মণ্য বিরোধী প্রতিবাদী ধর্মের নেতারা গেরুয়া পরতে শুরু করেন, ক্রমশঃ তা সাধু সন্ন্যাসীদের বসন হয়ে দাঁড়ায়। গেরুয়া বা গিরে মাটিতে ছোপানো পোশাকের রংকেই গেরুয়া বলা হত। এই গেরুয়া আদতে অত্যন্ত আধুনিক এক রং। এখন সেই রংয়ের ঠিকেদারি নিয়েছে কিছু মানুষ। এঁরা নিজেদের হিন্দু বলে দাবি করেন। তাদের পবিত্র রং নাকি এই গেরুয়া। শাহরুখ কেন খালি গায়ে, দীপিকা পাড়ুকোন কেন গেরুয়া রংয়ের বিকিনি পরে গান গাইছে, এই ইস্যুতে দেশজুড়ে ওই হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত মানুষজন ছবি ব্যান করার ফতোয়া জারিও করেছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী এঁদের বিরুদ্ধে কোনও কথা না বলার মানে হল এই হুলিগানিজম-এ তাঁর সায় আছে। আর এই ছোট ছোট বিভেদের মশলা দিয়েই তো মোদি–শাহ, বিজেপি-আরএসএস-এর রাজনৈতিক দর্শন তৈরি হয়েছে।
এঁদের কল্যাণে গাঁদা এখন হিন্দুদের ফুল, রজনীগন্ধা মুসলমানেদের, নারকেল আজ হিন্দুদের ফল আর খেজুর মুসলমানদের, এরাই ঠিক করে দেয় সবুজ হল মুসলমানদের রং আর গেরুয়া হল হিন্দুদের। অতএব গেরুয়া বিকিনি পরে নাচা যাবে না। পুরনো হিন্দি ছবিগুলোতে ডাকাতেরা আসত গেরুয়া ফেট্টি পরে জয় ভবানী বলে, কেউ তো প্রশ্ন করেনি। করেনি কারণ সেই প্রশ্ন বিভাজন তৈরি করে ভোট এনে দিত না। এখন করছে কারণ বিভাজনের রাজনীতিই ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করে দিচ্ছে, সেই জন্যই হিন্দু ব্রাহ্মণ ধর্ষকরা বেমালুম ছাড়া পেয়ে যায় জেল থেকে। কারণ তারা সংস্কারি মানুষ। সবথেকে আশ্চর্যের ব্য়াপার হল, যিনি এই কথা বুক বাজিয়ে বললেন তিনিও নির্বাচনে জিতলেন বিপুল ভোটে। কাজেই আকাশের বিভাজন হোক, বিভাজন হোক নদী জঙ্গলের, বিভাজিত হোক আমাদের পাহাড় পর্বত, ভেঙে দেওয়া হোক জলাশয়ের বর্ণপরিচয়, একই নিয়ম ধরে কিছু রং হবে হিন্দু, কিছু মুসলমান, রং চিনে চিনে কোতল হবে মানুষ, এটাই তো রাজনীতি।
এই রংয়ের পিছনে লুকিয়ে থাকা সত্যিটা আসুন দেখে নেওয়া যাক। আলো না থাকলে সমস্ত রং কালো, বিশাল নীলা আশমান রাতে কালো ঘুরঘুট্টি, অমাবস্যায় কালো আপনার প্রেমিকার মুখ। আবার রংয়ের না থাকাই হল সাদা, কোনও রংই নেই, আলো আছে, তাহলে তা সাদা দেখাবে, সাদাকে ভাঙলেই বেরিয়ে আসবে বেনীআসহকলা। পৃথিবীর সব রং এই সব রংয়েরই পারমুটেশন, কম্বিনেশন বা একটা বা দুটোর না থাকা। আমাদের পতাকায় যে রং আছে তা কমলা, স্যাফ্রন, কেশরী, অনেকে গেরুয়াও বলবেন, তো সেই রংয়ে ২৫৫ ভাগ লাল, ১৫৩ ভাগ সবুজ আর ৫১ ভাগ নীল আছে। ফলে রংয়ের ফারাক যারা করে তাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের গেরুয়া আলাদা, ইসকনের গেরুয়া আলাদা। মমতার সামনে অরিজিৎ গাইলেন রঙ দে তু মোহে গেরুয়া, অমনি ওই সব মানুষজনের কী লাফালাফি, গেরুয়া, গেরুয়া। বোঝাই গেল না সমস্যাটা কোথায়?
এই রংবাজির পিছনের আসল কারণ হল সর্বত্র এক ধর্ম জিগির তুলে রাখতে হবে, সর্বত্র হিন্দু আর মুসলমান বিভাজন দরকার, দরকার নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানোর জন্য, দেশের ৭৮.৯ শতাংশ হিন্দু। কিন্তু আরএসএস আর বিজেপির দুঃখ হল এখনও মাত্র দেশের ৪০ শতাংশ হিন্দু বিজেপিকে ভোট দেয়, বিজেপি চায় এক তীব্র ইসলাম বিদ্বেষী হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক, যা দেশের হিন্দু জনসংখ্যার অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশ হবে। তার মানে মোট ভোটের ৫৬ থেকে ৬০ শতাংশ, এই বিভাজনে মানুষকে একবার আনলে বিজেপির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং মৌরুসিপাট্টা বজায় থাকবে। বিরোধীরা যাই করুক না কেন, মূল্যবৃদ্ধি যেখানেই যাক না কেন, বেকারত্ব যত বাড়ুক না কেন, অর্থনীতি যে তলানিতেই ঠেকুক না কেন বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। সেই জন্যই তারা দলীয় কর্মসূচিতে, সরকারি স্তরে, বিভিন্ন বিল এবং সরকারি পদক্ষেপে, বিভিন্ন উগ্র হিন্দু সংগঠনের কর্মসূচির মাধ্যমে এই বিভাজন বিষকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, লক্ষ্য ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা, আর কিচ্ছু নয়।
স্যাফ্রন নিয়ে আরও কিছু কথা, আমাদের ভাগওয়া রং বা কেশরী হল ডিপ স্যাফ্রন। লাল ২৪৪, সবুজ ১৯৬ আর নীল ৯৮-এ ই অনুপাতে মেলালেই হয়ে যাবে সেই গাঢ় স্যাফ্রন। মজার কথা হল এই স্যাফ্রন রংটাও এসেছে ইরান থেকে, মানে সেই পারস্য, হিন্দিতেও সবুজ কথাটা ব্যবহার করা হয়, সেই সবুজ শব্দটাও কিন্তু ফারসি, আবার সফেদ শব্দটাও ফারসি। অর্থাৎ, আমাদের জাতীয় পতাকার তিনটে রং, সফেদ, যা আসলে কোনও রং নয়, রং না থাকার ফলে যে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়ে তা হল সফেদ, কিন্তু শব্দটা ফারসি। গেরুয়া বা ডিপ স্যাফ্রন, যে স্যাফ্রন রংটাই এসেছে পারস্য থেকে আর সবুজ, শব্দটা ফারসি আর ইসলাম ধর্মের প্রতীক। এই কারণেই যখন আমাদের সংবিধান প্রণেতারা দেশের জাতীয় পতাকার রং বেছে নিলেন, ত্যাগ শান্তি আর অগ্রগতির রং স্যাফ্রন, সফেদ আর সবুজ তখন সব থেকে বিরোধিতা করেছিল এই আরএসএস। আরএসএস পত্রিকা অর্গানাইজার-এ স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন আরএসএস-এর গুরু গোলওয়ালকর লিখছেন, যারা ভাগ্যের জোরে আজ ক্ষমতায় এসেছে, তারা আমাদের হাতে এই ত্রিবর্ণ পতাকা তুলে দিয়েছে, কিন্তু এই ত্রিবর্ণ পতাকাকে কোনওদিনও কোনও হিন্দু সম্মান করবে না। তিন শব্দটাই অশুভ, আর সেই তিন রংয়ের পতাকা দেশের উপর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব ফেলবে, দেশের পক্ষে তা ক্ষতিকর। তো এই গোলওয়ালকরকে নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি গুরু বলেন, সেই মোদিই ত্রিবর্ণ পতাকা তোলেন দিল্লির লাল কেল্লায়!!!