চারদিন পেরিয়ে অবশেষে হদিশ মিলল নিখোঁজ পর্যটন ডুবোজাহাজ ‘টাইটান’-র। পাঁচ অভিযাত্রী বোঝাই ওই সাবমেরিনের ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পেল রোবট ডুবুরি। আটলান্টিকের গভীরে পড়ে থাকা ‘আরএমএস টাইটানিক’-র কাছেই ডুবোজাহাজটির ধ্বংসাবশেষ মিলেছে বলে জানা গিয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যটন সাবমেরিন ‘টাইটান’-র খোঁজ মেলার খবর টুইট করে জানায় মার্কিন কোস্ট গার্ড। সেখানে বলা হয়, দূর থেকে চালিত স্বয়ংক্রিয় যান ডুবোজাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছে। সেটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরেই ডুবোজাহাজের মধ্যের অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। ফলে অভিযাত্রীদের জীবিত দেখতে পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, বুধবার প্রথম সমুদ্রের নীচের থেকে ভেসে আসা শব্দ চিহ্নিত করে কানাডার পি-থ্রি বিমান। এর পর সি-১৩০ হারকিউলিসও একই ধরনের শব্দকে চিহ্নিত করে। ফলে সমুদ্রের ওই অংশে যে ডুবোজাহাজটি রয়েছে, এরপর তা এক রকম নিশ্চিত হয়ে যান মার্কিন কোস্ট গার্ডের অফিসাররা। ডুবোজাহাজ ‘টাইটান’-র কাছে পৌঁছতে এরপরই তল্লাশিতে বদল আনা হয়। সমুদ্রের ওই অংশে নামানো হয় দু’দু’টি রোবট। আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনী সূত্রে খবর, ওই যন্ত্রমানবের একটি ‘টাইটান’-র ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেছে। প্রসঙ্গত, মার্কিন কোস্ট গার্ডের রোবটগুলি জলের নীচে প্রায় দু’মাইল গভীর পর্যন্ত গিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ১৯১২-য় উত্তর আটলান্টিকে বিরাট একটি হিমশৈলে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় আরএসএস টাইটানিক। মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় যাত্রী ও ক্রু মেম্বার মিলিয়ে মারা যান দেড় হাজার জন। ১১১ বছর ধরে সমুদ্রের গভীরে পড়ে থাকা ওই অভিশপ্ত জাহাজকে চাক্ষুস করার বন্দোবস্ত করে ওশেনগেট এক্সপিডিশন নামের একটি মার্কিন বেসরকারি সংস্থা। গত রবিবার এই উদ্দেশ্যেই কানাডার নিউ সাউথহ্য়াম্পটনের সেন্ট জন্স থেকে আটলান্টিকে ডুব দেয় ওশেনগেটের ডুবোজাহাজ ‘টাইটান’। পাঁচ অভিযাত্রী নিয়ে টাইটানিকের দিকে রওনা হয় সাবমেরিনটি। এখানে বলে রাখা শ্রেয়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার ফুট গভীরে পড়ে রয়েছে আরএমএস টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু যাত্রা শুরুর পৌনে দু’ঘণ্টার মধ্যেই দিক নির্দেশকারী জাহাজ বা কমান্ড শিপ ‘পোলার প্রিন্স’-র সঙ্গ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ‘টাইটান’-র। খবর পেয়ে উদ্ধার কার্যে নামে মার্কিন উপকূলরক্ষী বাহিনী। রবিবার যে ‘টাইটান’-টাইটানিকের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তাতে অভিযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ ধনকুবের হামিশ হার্ডিং এবং পাকিস্তানের ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ ও তাঁর ছেলে সুলেমান। এছাড়া গাইড হিসেবে তাঁদের সঙ্গী হন টাইটানিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ফরাসি নৌসেনার প্রাক্তন ডুবুরি বছর ৭৭-র পল হেনরি নারজিওলেট। ‘টাইটান’-র পাইলটের কেবিনের দায়িত্ব নেন ওশেনগেটের সিইও স্ককটন রাশ। ওসিয়ান গেট-এর সিইও স্টকটোন রাশ হলেন স্ট্রস দম্পতির প্রপৌত্রী ওয়েন্ডি রাশের স্বামী। আর ওয়েন্ডি এই সংস্থার বোর্ড মেম্বার। ফলে সংস্থার তরফেই তিনি যাত্রী নিয়ে টাইটানিক-এর ধ্বংসাবশেষ দেখতে আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে পাড়ি দেন। এর আর দু-বার আটলান্টিক মহাসাগরে পাড়ি দিয়েছিলেন ওয়েন্ডি। ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু, তৃতীয়বারে টাইটান-এর সঙ্গেই নিখোঁজ হয়ে গেলেন ওয়েন্ডি। সূত্রে খবর, স্ট্রস দম্পতির একমাত্র মেয়ে মিনি। তিনি ১৯০৫ সালে ডা. রিচার্ড উইলে কিয়ে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের পুত্র জুনিয়ার উইল নিউ ইয়র্কের মেসির প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর পুত্র তৃতীয় রিচার্ড উইল পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। তাঁরই মেয়ে হলেন ওয়েন্ডি রাশ। তিনি ১৯৮৬ সালে স্টকটোন রাশকে বিয়ে করেন।
আর এখানেই যেন ডুবোযান ‘টাইটান’ এর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে মিলিয়ে দিল ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘টাইটানিক’-কে। ১৯১২ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের যকন অতলে তলিয়ে যায় বিলাসবহুল জাহাজ ‘টাইটানিক’, সেই সময় জাহাজের অন্যতম যাত্রী ছিলেন বৃদ্ধ দম্পতি, ইডিটর স্ট্রস ও ইডা স্ট্রস। ভালবাসা যে কী হয়, সেটা এই বৃদ্ধ দম্পতির মাধ্যমে টাইটানিক সিনেমায় তুলে ধরেছিলেন পরিচালক জেমস ক্যামেরন। লাইফ জ্যাকেট খুলে ফেলে পরস্পর পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে একসঙ্গে বিছানায় শুয়ে শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন স্ট্রস দম্পতি। সেই ঘটনা মিথ্যা ছিল না। সেজন্যই জ্যাক-রোজের মতো আজও দর্শকদের মণিকোঠায় রয়ে গিয়েছেন স্ট্রস দম্পতি। টাইটানিকের অতলান্তের সঙ্গেই হিমশীতল আটলান্টিক মহাসাগরের জলে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁদের। এবার সেই একই পরিণতির শিকার হলেন তাঁদের প্রপৌত্রী ওয়েন্ডি রাশ। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস!