শুভাশিস বিশ্বাস
ভারতীয় এবং বিদেশি সিনেমা পরিচালক এবং প্রযোজকদের বহু সিনেমাই প্রদর্শিত হচ্ছে ২০২৩-এর কলকাতা আন্তর্জাতির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। এঁদের এই কর্মকাণ্ডের অংশীদারিত্বে এবার ভাগ বসিয়েছেন খাস কলকাতার এক সাংবাদিকও। তাঁর এবারের এই তথ্যচিত্রটি মূলত পশ্চিমবঙ্গের বিলুপ্তপ্রায় শবর জনজাতির জীবন ও কাহিনি নিয়ে। তাঁর এই কাজ রুপোলি পর্দায় তুলে ধরা হবে শনিবার এবং সোমবার শিশির মঞ্চ এবং নন্দন-৩-এ। এখানে বলে রাখা ভাল, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে ‘শ্রিংকিং অব দ্য স্টার্ডি-শবর টেলস’ শিরোনামের তাঁর এই ছবিটি। যেখানে ইংরেজি সাবটাইটেলসহ বাংলায় উপস্থাপন করা হচ্ছে এই তথ্যচিত্র।
এই ছবিটিতে মূলত তুলে ধরা হয়েছে শবর উপজাতির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কথা। যে জীবন সমস্যাসঙ্কুল। বঞ্চনা, শোষণ আর দারিদ্র্য যেন জড়িয়ে রয়েছে প্রতি পদে। জীবনে নেই কোনও আশা-আকাঙ্ক্ষা, তবে রয়েছে মৃত্যু সম্পর্কে এক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি।
এই ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ১৮৭১ সালে ফৌজদারি উপজাতি আইনের অধীনে শবরদের কলঙ্কিত এবং তাঁদের অভ্যাসগত অপরাধী হিসাবে তকমা দেওয়ার ঘটনার কথাও। আর সেখান থেকেই যেন শবরদের দুর্দশার দিন শেষ হতে চায় না। সময়ের কালে এই আইন বাতিল হয়েছে ঠিকই, তবে প্রতিবেশী রাজ্যগুলির মতো পশ্চিমবঙ্গেও শবরদের দুর্বল উপজাতি গোষ্ঠী হিসাবে এখনও কোনও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আর এরই প্রেক্ষিতে এই তথ্যচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে তাঁদের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য শবরদের সংগ্রামের নানা ঘটনা। বামফ্রন্টের শাসনকালে এঁদের এই দুরবস্থার ভার কিছুটা লাঘব হলেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায়নি কোনও পরিবর্তন। ফলে জীবনের প্রতি পদক্ষেপে রয়েছে এক চ্য়ালেঞ্জ। শবরদের এই জীবনযাত্রা তুলে ধরার ফাঁকে ধরা পড়েছে শবর রমনীদের হতদরিদ্র চেহারাও। অপুষ্টিতে ভুগছেন তাঁরা। এদিকে সমীক্ষা বলছে, শবর মহিলাদের মধ্যে অপুষ্টির প্রাথমিক কারণ হল দারিদ্র্য। যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে শিশুদের ওপরেও। সারা বিশ্ব যখন বর্তমান প্রযুক্তির হাত ধরে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা জয় করে চলেছে, ঠিক এমনই এক সময়ে এই শবরদের ঘরে পৌঁছায়নি আধুনিকতার আলো। শবর পাড়ায় ঢুকলে নজরে আসে সেই চেনা দারিদ্রের ছবি। মাটির দেওয়াল, খোড়ো চালের ভাঙাচোরা বাড়ি, নোংরা, আবর্জনায় ভর্তি। একটি বাড়ির উঠোনে শিশুর সঙ্গে ভাগ করে ভাত খাচ্ছেন বাবা। হয়তো রেশন কার্ড মোটামুটি সবার থাকায় দু’টাকা কিলো দরে চালও পান। তবে সমস্যা হল, এখানে কারও অসুখ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে গাড়িভাড়া জোটানোই অসম্ভব হয়ে পড়ে এঁদের। আর হবে নাই বা কেন, রাজনৈতিক ময়দানে শবরদের ভোটে খুব একটা হেরফের ঘটবে না কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে। ফলে এই শবরদের নিয়ে নেই কারও মাথা ব্যথাও। এদিকে শবরদের উন্নয়নে প্রচুর টাকাও আসে। যেহেতু এরা লেখাপড়া জানে না, তাই কী সাহায্য এসেছে তা জানা যায় না। মাঝপথে নেপোয় দই খেয়ে যায়। শবর সমিতির সঙ্গে যাদের সম্পর্ক আছে, তারা সুযোগ পান। এই সমগ্র ঘটনার জেরে শবর শিশুরাও আজ এক অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখোমুখি।
সিনেমার শ্যুটিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে অভিজিৎবাবু জানান, পুরুলিয়া হয়েছে এই ছবির কাজ। এই জেলার আটটি ব্লকে রয়েছেন ৩১৭৬টি পরিবার। যাঁদের ১২,৩৪৪ জন বন-আবাসিক ১৬৮ টি গ্রামে বসবাস করেন। তবে সময়ের সঙ্গে কমেছে এঁদের শারীরিক শক্তি। তবে তাঁদের সেই সরলতা চিরভাস্বর। এঁদের এই দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম চিত্রিত করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এই প্রসঙ্গে অভিজিৎবাবু এও জানান, ‘এই অরণ্যজীবীরা পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁদের বেঁচে থাকার তাগিদে। যে বিপন্নতা আজ তৈরি হয়েছে পরিবেশে তার বীজ রোপিত হয়েছে তথাকথিত সভ্য মানুষের হাত ধরেই। যে কারণে আজ পৃথিবীর অস্তিত্ব বিপন্ন। একইসঙ্গে বিপন্ন এই অরণ্যজীবীরাও।’ উল্লেখ্য, চলচ্চিত্রটির সংগীতায়োজন করেছেন দুই শবর যুবক ও একজন সাঁওতাল উপজাতির। মূল অভিনেতারাও সবাই শবর প্রবাসী।
এখানে আরও একটা তথ্য অভিজিৎ চক্রবর্তী সম্পর্কে দিয়ে রাখা প্রয়োজন, তা হল সুন্দরবনের জীবন নিয়ে ‘সুন্দরবন-সাগা অফ দ্য হাঙ্গরি টাইডস’-নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন গত বছরেই। পরপর দু’বছর কলাকাত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এগুলি নমিনেটেড হয়েছে আর প্রিমিয়ারও হচ্ছে। এরপর তাঁরই হাতে তৈরি হল শবরদের নিয়ে এবারের এই তথ্যচিত্র। বর্তমানে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী অন্যান্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবিটি পাড়ি দেওয়ার রাস্তাকে যে প্রশস্ত করবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।