মহার্ঘ বাঙালির প্রতিমুহূর্তের সাথী চাল। হু হু করে বাড়ছে দাম। এক ঝটকায় কেজি প্রতি চালের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। মিনিকেট, রত্না, বাঁশকাঠি থেকে গোবিন্দ ভোগ- সব চালই এখন মহার্ঘ। চাল কিনতে এসে মাথায় হাত পড়ছে ক্রেতাদের। যেদিকে চালের দাম এগোচ্ছে, তাতে বাজার আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। চালের এই দামের গ্রাফ শুধু কেবল কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গই উর্ধ্বমুখী নয়, চালের বেচাল অবস্থা উত্তরবঙ্গেও।
যে মিনিকেট কয়েকদিন আগেও মিলছিল ৫০ টাকা প্রতি কেজি দরে তা এখন ৬০-৬২ টাকা প্রতি কেজি।
রত্নার দাম ছিল ৪৩ টাকা প্রতি কেজি, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা প্রতি কেজি।
বাঁশকাঠির দাম ছিল ৭২ টাকা প্রতি কেজি, বর্তমানে সেই বাঁশকাঠির দাম ৮০ টাকা প্রতি কেজি। গোবিন্দভোগের দাম ছিল ৮৫ টাকা প্রতি কেজি, এখন তারই দাম ১০০ টাকা প্রতি কেজি।
চালের দাম বৃদ্ধির কারণ নিয়ে একাধিক মত কারবারি থেকে মিল মালিকদের। উঠে আসছে, একাধিক তত্ত্ব।
প্রথমেই এই ঘটনায় যে তত্ত্ব সামনে আসছে তা হল, কৃত্রিম অভাব তৈরি করে মুনাফা লোটার চেষ্টা চলছে। এই পরিস্থিতির জন্য এক শ্রেণির মুনাফাবাজ চাল বিক্রেতাদেরই দায়ী করছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ।
আরও একটি কারণ হল, রফতানির বিষয়। বাংলাদেশের অচলাবস্থায় ওপার বাংলায় বেশি পরিমাণ চাল পাঠানো হচ্ছে। তাতে এপার বাংলায় চালের দাম বেড়ে গিয়েছে। তাতেই এখানে স্টক কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে চালের দাম।
আরেকটি তত্ত্ব বলছে, বাংলাদেশ তো বটেই, বাংলাদেশের থেকেও চালের রফতানি বেড়েছে ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। চা ব্যবসায়ীরাই বলছেন, এই দুটি দেশ অন্যান্য বছর এত চাল স্টক করে না। কিন্তু এ বছরই তারা বেশি চাল মজুত করছে। ফলে সেখানেই চাল বেড়িয়ে যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি এ অভিযোগও উঠছে যে, মুনাফাবাজ ব্যবসায়ীরা ফসল ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টক বাড়াচ্ছেন। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, তাঁরা একেবারে ক্ষেত থেকেই চাল ধান মুষ্টিবদ্ধ করে নিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সরকার এ ব্য়াপারে উদাসীন কেন তা নিয়েও।
এই প্রসঙ্গে চাল ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ‘যার যেখানে লাভ, সেখানেই যাবে। বেশি দামে বাইরে যাচ্ছে, তাই লোকে সেখানেই ব্যবসা করার চেষ্টা করছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মার্কেট ছোট হয়ে গিয়েছে।’ আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছে সমস্ত মোকামরা ইচ্ছাকৃতভাবে চালের দাম বাড়াচ্ছে। কুটিগাল যাঁরা চাল তৈরি করে, তাঁরাও বাড়াচ্ছে। আমি তো বাজার চষে এসেছি, দেখছি ভাল ভাল কুটিগালদের কাছে ভাল ধান রয়েছে।’
চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে চাষিদের আবার অভিযোগ, তাঁরা ধান বিক্রির সময় বেশি দাম পাননি। ধান উৎপাদনও যথেষ্ট হয়েছে। এই সময় চালের দাম এভাবে বৃদ্ধি হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিছু রাইসমিলার ও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে মার্কেটে ‘ঘাটতি’ সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়াচ্ছে। যেহেতু চাষিদের হাতে এখন ধান নেই তাই ইচ্ছামতো দাম বাড়ানো হচ্ছে।
যদিও চাষিদের অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাইসমিল মালিকেরা। তাঁদের বক্তব্য, সরু চালের চাহিদা বেড়েছে। এছাড়াও এবছর বেশ চাল রফতানি বেশি পরিমাণে হয়েছে। তাই বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কয়েকদিনের মধ্যে এই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে জানাচ্ছেন রাইসমিলাররা।
গত মরসুমে আমন ধানের চাষ কম হয়েছিল। বোরোধানের অধিকাংশই মিনিকিট চালের জন্য ব্যবহৃত হয়। ফলে একাধিক কারণে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী বলে মনে করছেন কারবারিরা।
মোটা চালের দাম সেই ভাবে বাড়েনি। মোটা চাল সরকারি রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেওয়া হয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় নষ্ট হয়েছে সরু ধানে যোগান কম রাইস মিলে। চাষিদের দাবি, তাঁদের উৎপাদিত মোটা ধান তারা সরকারি কৃষাণ মান্ডিতে বিক্রি করে দেন। বাড়ির জন্য সরু মিনিকিট চাল বাজার থেকে কিনে নেন। অন্যদিকে গ্রীষ্মে সরু ধানের চাষ হয়। উৎপাদনের খরচ বেশি গ্রীষ্মের ধানের। গ্রীষ্মে ধানের চাষ বাড়েনি। ফলে উৎপাদন একই থাকায় চালের চাহিদা বাড়ায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এমনটাই মনে করছেন চাষিরাও।
কিন্তু এসবের মধ্যে মাথায় হাত পড়েছে মধ্যবিত্তদের। এক ক্রেতা বললেন, ‘বিরাট অসুবিধার মধ্যে আছি। আগে যে চাল ১২৮০ টাকা নিচ্ছিল, এখন ১৪০০-র ওপরে চলে গিয়েছে। ২৫ কেজির বস্তা। রোজগার তো বাড়ছে না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।’