উত্তর ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন কৃষকেরাই

‘গণতন্ত্র’ শব্দটা আরএসএস-বিজেপির দর্শনের সঙ্গে যায় না। তাদের দর্শনের ভিত্তিই হল স্বৈরতন্ত্র, এক জাতি, এক ভাষা, এক দেশ, এক ধর্ম, আরএসএস ফ্ল্যাগে ওম চিহ্ন আছে আর হিটলারের, নাৎসিদের ফ্ল্যাগে স্বস্তিকা চিহ্ন ছিল, এই যা তফাত। গণতন্ত্র যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, জাত, ভাষা, বিভিন্ন রুচির মানুষকে নিয়ে চলার কথা বলে, সেখানে আরএসএস-এর গণতন্ত্র আসলে এক ধর্ম, এক ভাষা, এক নেতার, এক দর্শনের কথা বলে। তাই গণতন্ত্র বলতে ঠিক কী বোঝায় তা তাদের জানা নেই। সম্বিত পাত্র, অমিত মালব্যরা নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক দর্শনকেই গণতন্ত্র বলে চালাতে চান। অপেক্ষা আর কয়েকটা বছরের, আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রকেও বাতিল করে দেবেন তাঁরা। তাই তাঁরা বলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ এক সরকার, তার ইচ্ছে খুশি মতো আইন করতে পারে।

এদিকে ইতিহাস বলছে,  ১৯৪৭ দেশ স্বাধীন হল, নেহরু প্যাটেল ছিলেন ভাষাভিত্তিক রাজ্য তৈরির বিরোধী, গান্ধি আম্বেদকর ভাষাভিত্তিক রাজ্য তৈরির পক্ষে। বিভিন্ন রাজ্যে আন্দোলন শুরু হল, ১৯৫৩তে তেলুগু ভাষার ভিত্তিতে আন্দোলন চলাকালীন পত্তি শ্রীরামালু ৫৬ দিন অনশনের পরে, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫২তে মারা যান। নেহরু মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ভেঙে অন্ধ্র তৈরি করার ঘোষণা করেন, ১৯৫৩তে অন্ধ্র তৈরি হয়। এটাই গণতন্ত্র। ১৯৫৬ বঙ্গ-বিহার সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিনহার। বাংলায় ২৩৮টা আসনের মধ্যে ১৫০টা জাতীয় কংগ্রেসের কিন্তু রাজ্য জুড়ে বামপন্থীদের প্রচার সংযুক্তিকরণের বিরুদ্ধে। কলকাতা উত্তর পশ্চিমের সাংসদ মেঘনাথ সাহার মৃত্যুতে উপনির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ওই আসনে। বিধান রায় বললেন, মানুষ যদি ওই আসনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট দেয়, তাহলে আমরা সংযুক্তিকরণের কথা আর তুলব না। কলকাতা উত্তর পশ্চিমে কমিউনিস্ট প্রার্থী মোহিত মৈত্র জয়ী হন। এরপরই বিধান রায় ফিরিয়ে নিলেন সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব, এটাই গণতন্ত্র। প্রেস বিল এনেছিলেন, ১৯৮০তে জগন্নাথ মিশ্র, পাশও হয়েছিল, বিহার বিধানসভায়। সারা বিহারে আন্দোলন শুরু হল। তিনি প্রেস বিল ফেরত নেন। এটাই গণতন্ত্র।

গণতন্ত্রে একবার নির্বাচিত হলেই যা খুশি করার অধিকার নেই বলেই, সংসদ আছে, অধিবেশন আছে, তর্ক-বিতর্ক আছে, ভোটাভুটি আছে, এবং বিল হওয়ার পরেও তা প্রত্যাহার আছে, সংশোধন আছে, বাজেট পাশ হওয়ার পরেও রোল ব্যাক আছে।ইন্দিরা গান্ধি সংসদকে এড়িয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, তারপর সে আইন সংসদে পাশ করিয়েছিলেন তাতে সংসদে বলার মত শক্তি ছিল না বিরোধীদের। তারা রাস্তায় বিরোধিতা করেছিলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ সম্পূর্ণ ক্রান্তির স্লোগান দিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিলেন বিজেপির নেতারা, ছিলেন বাজপেয়ী, আদবানি, জেটলি, সুষমা স্বরাজেরা। নরেন্দ্র মোদি নিজে বলেন বটে যে তিনি ওই আন্দোলনে ছিলেন, তবে তার কোনও প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। বিষয়টা হল, সংখ্যাগরিষ্ঠতাই গণতন্ত্রে সবথেকে বড় কথা নয়, বরং গণতন্ত্রের উদগাতারা ভয়েজ অফ ডিসেন্টকে, ভয়েজ অফ মাইনরিটিকেই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, সংখ্যালঘু বিরোধী দলই আসলে এক অঙ্কুশ যা গণতন্ত্র কে রক্ষা করে, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতাই আইন জারি করার একমাত্র কারণ হতে পারে না, আইনত সে আইন জারি করাই যায়, মানুষ না মানলে, সে আইন ফেরত নেওয়া হয়, সেটাই গণতন্ত্র।

এবার সেই কথা ভাবার সময় এসেছে। কৃষকরা জানিয়ে দিয়েছেন, বিচ কা রাস্তা নহি হ্যায়। স্বাধীনতার পরে কৃষকদের আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, বাংলার মধ্যে, এবং তা ছিল মূলত ফসল, আনাজের ভাগের লড়াই। সবুজ বিপ্লবের পর পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সম্পন্ন চাষি, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশের আখ, পেঁয়াজ, বাদাম চাষিদের সঙ্গে দেশের প্রান্তিক ছোট চাষিদের বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়। একধারে বড় জোত, অন্যধারে ক্যাশ ক্রপ অর্থনীতিতে তাঁদের অন্য মাত্রা দিতে থাকে। অন্যধারে সবুজ বিপ্লবের স্রেফ সার আর বীজের সাহায্য নিয়ে দেশের প্রান্তিক চাষিরা, না খেতে পাওয়া প্রান্তিক চাষিরা কোনও রকমে খাবার জোগাড় করতে সক্ষম হয়। দেশে সফল ভূমি সংস্কার ৭৭-এ বামফ্রন্ট এনেছে বলে একটা চালু মিথ আছে বটে কিন্তু আদতে সারা দেশে প্রথম সফল ভূমি সংস্কার হয় কাশ্মীরে। সেখানকার বাগিচা ফসল, আপেল, জাফরান, আখরোট, খুবানি ইত্যাদি তাদের এক ধরনের সম্পন্নতা দেয়। এর সঙ্গে কাশ্মীরে কৃষিমজুর আমদানি হতে থাকে বিহার, ইউপি, বাংলা থেকে, সে সব কৃষি মজুরদের শোষণ তখন, এখনও অবর্ণনীয়। বাংলায় ভূমি সংস্কার হয় বটে, কিন্তু তার পরের ধাপ, যৌথ খামারে যাওয়ার সাহস দেখায়নি বামেরা, তাদের সে দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল না, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ উৎপাদনকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, তারও ন্যূনতম ধারণা ছিল না তাদের। তাই কমিউনিস্ট নেতার মুখে শোনা গিয়েছিল, চাষির ব্যাটা কি চাষিই হবে? মানে চাষাভুসো সম্পর্কিত ফিউডাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাঁরা বের হতে পারেননি। অতএব এমনকী চারফসলা জমিতে, কারখানার সেমসাইড গোল করতে তাঁরা নেমে পড়লেন, আন্দোলন হল। তবে সেটা যত না কৃষকের আন্দোলন, তার চেয়েও বেশি গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায়। সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরবে না, বিরোধী দল, সিভিল সোসাইটিরা তাদের অবস্থান থেকে নড়বেন না। কৃষকরা বড়জোর সঙ্গে ছিলেন। আদতে এ লড়াই ছিল, সরকারের জোর করে জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই। কৃষকদের চাষ, ফসল, মূল্য নিয়ে আন্দোলন নয়, তাদের জমি থাকবে কি থাকবে না, সরকারের ইচ্ছে হলেই কেড়ে নেওয়া যাবে কি যাবে না তা নিয়ে লড়াই। সে লড়াই দেশে নয় পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত হয়েছে, সরকার পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আইনের বেশ কিছু সংশোধন হয়েছে, দেশে তারপরেও জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন চলছে, সে আন্দোলন একা কৃষকদের আন্দোলন নয়।

সেই অর্থে,এই প্রথম কৃষকরা তেভাগা আন্দোলনের পরে তাদের ফসলের লড়াইয়ে নেমেছেন তফাত মূলত দুটো। এক, এখানে সম্পন্ন চাষিরাই আগে নেমেছে, বাকিরা সাইডলাইন থেকে মাঠে নামা শুরু করেছে। দুই, সেবার লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। এবার কৃষকদের আন্দোলনে  কৃষকদেরই, পাশে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক দল। মাথায় নয়। কৃষকরা সংসদে প্রতিনিধি চাইছে না, তারা নির্বাচনের কথা বলছে না, তাদের স্পষ্ট দাবি কৃষি ও কৃষি সংক্রান্ত বিল ফেরত নেওয়াটাই যথেষ্ট নয়, এমএসপি, মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসকে আইনের অন্তর্গত করতে হবে, এমএসপি নিয়ে আইন আনতে হবে। এই কিন্তু ছোট চাষি, বাংলার চাষিদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এটা আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। যা দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের ইস্তেহারে। সেখানে রয়েছে এমএসপির কথা, এমএসপির গ্যারান্টির কথা। মজার কথা হল, এখনও পর্যন্ত মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস কিন্তু একটা সরকারি ঘোষণা, এটা আইন নয়। মানে কেউ যদি এমএসপির নিচে আনাজ কেনে তাকে জেলে পাঠানো যাবে না, কোনও এক সময়ে যদি সরকারও এমএসপি না দেয়, তাহলেও তাকে আইনের সামনে দাঁড় করানো যাবে না। প্রান্তিক চাষিদের সমস্যাটা এখানেই, তাদের সামান্য উৎপাদন নিয়ে তারা অনেক সময়েই মান্ডিতে যেতে পারে না, ফড়েরা এসে অনেক কম দামে কিনে নিয়ে যায়, ধানকল, গমকল, তেলকলে বিক্রি করে, এই প্রথম তাগড়া দাবি উঠল, এমএসপিকে আইন করতে হবে। এমএসপি যদি আইন হয়, তাহলে ফড়েরাও গ্রামে এসে কম দামে ধান, গম কিনতে গেলে তা বেআইনি হবে, পুলিশ, থানা হবে। সুতরাং কৃষকরা একটু ঐক্যবদ্ধ থাকলেই এমএসপি পাবে, এটা কৃষকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  যেমন, এ বছরে সাধারণ মানের ধানের সাপোর্ট প্রাইস ১৮৬৮ টাকা, বাংলার গ্রামে গ্রামে ফড়েরা ধান কিনছে ১৪০০ টাকা কুইন্টাল, অর্থাৎ এমএসপি আইন হলে কৃষকরা অনেক টাকা বেশি রোজগার করতে পারবে। এমনকী ছোট কৃষক, মাঝারি কৃষকরাও। তাই এবারে এমএসপির দাবি উঠছে। আর তা না মানা হলে আরও ট্রাক্টর এগোবে, দিল্লির দিকে, আরও কৃষক যাবেন দিল্লি অভিমুখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − nine =