শহরের ১৫৩ বছরের ট্রামের ইতিহাসে এই প্রথমবার এফআইআর দায়ের।সম্প্রতি এমজি রোড ও রবীন্দ্র সরণির ক্রসিংয়ে পিচ ঢেলে ট্রামলাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর এই ঘটনাটি সামনে আসার পরেই আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে আইনি পথে হাঁটল ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশন।শহরের. ট্রাম সংগঠনের পক্ষ থেকে রবিবার বড়বাজার থানায় একটি এফআইআর দায়ের করা হয়।
শহরের একাধিক ট্রাম ট্র্যাকের উপরে পিচ ঢেলে সেগুলি বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করা হয়েছিল। সেই মামলায় চলতি বছরের গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির স্পষ্ট নির্দেশ দেন, পিচ বা বিটুমিন দিয়ে কোনও ট্রাম ট্র্যাক বন্ধ করা যাবে না । কিন্তু তারপরেও সম্প্রতি চিৎপুর ক্রসিং বা এমজি রোড এবং রবীন্দ্র সরণি ক্রসিং ট্রামলাইনে ঢালা যাবে না পিচ।
এদিকে ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের ধারনা, চলতি মাসের প্রথম দিকেই চিৎপুর ক্রসিংয়ে পিচ ঢালার কাজ হয়েছে। ট্রাম পরিবহণের ক্ষেত্রে এই ক্রসিংটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণয. কারণ এই স্থান যেমন তিনটি ট্র্যাকের সংযোগস্থল, তেমনই এই স্থানে যে তিনটি ট্রাম ট্র্যাক রয়েছে তার মাধ্যমে ন‘টি রুটে ট্রাম চলাচল করতো।
এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাইকোর্টে ট্রাম সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে মামলাকারীর পক্ষের তরফে অভিযোগ তোলা হয় যে কালীঘাট, ভবানীপুর, জাজেস কোর্ট বা আলিপুর এবং খিদিরপুরের ট্রামলাইন পিচ ঢেলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওই মামলায় আদালত কড়া মনোভাব পোষণ করে জানতে চেয়েছিল যে, কে বা কারা ট্রাম ট্র্যাক বিটুমিনাইজেশনের নির্দেশ দিয়েছিল সে ব্যাপারেও।
মামলায় প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি চৈতালি চট্টোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আদালতের গঠিত অ্যাডভাইজারি কমিটির রিপোর্ট না–আসা পর্যন্ত শহরের কোনও ট্রাম রুট বন্ধ করা যাবে না বা পিচ ঢেলে ট্রামের ট্র্যাক বোজানো যাবে না । কিন্তু এই নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও চিৎপুরে ও রবীন্দ্র সরণিতে আবারও একই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ।
এই প্রসঙ্গে ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেবাশিস ভট্টাচার্য জানান, ‘গত কয়েক বছর ধরে শহরের একাধিক ট্রামলাইন পিচ ঢেলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদ করে ‘পাবলিক‘ বলে একটি সামাজিক সংগঠন আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল যে, কোনও ট্রাম ট্রাকের উপরে পিচ ঢেলে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এই নির্দেশিকার পরেও কালীঘাট থেকে হাজরা পর্যন্ত ট্রামলাইনের উপরে পিচ ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনার পরে আদালত অবমাননার মামলাও দায়ের করা হয় এবং দ্বিতীয়বারও আদালত জানিয়েছিল যে, কোনও ট্র্যাক, সেখানে ট্রাম চলুক বা না চলুক, তার উপরে পিচ ঢেলে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কিন্তু তারপরও সম্প্রতি দেখা গেল যে, এমজি রোড এবং রবীন্দ্র সরণির ক্রসিংয়ে আবার পিচ ঢেলে ট্রাম ট্র্যাক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ দ্বিতীয়বার আদালত অবমাননার ঘটনা ঘটল।’
সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, পিচ ঢালার কাজটা খুব একটা ছোট কাজ নয়, এর জন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতি এবং দক্ষতার প্রয়োজন হয় । তাই এই কাজটা কলকাতা পুরনিগমকে দিয়েই করানো হয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস । এর কোনও প্রমাণ না–থাকলেও পারিপার্শ্বিক তথ্য–প্রমাণ দেখে তারা এমনটাই মনে করছে বলে জানিয়েছে সংগঠন ৷ চিৎপুরের মতো একটা বড় রাস্তায় যেভাবে পিচ ঢালা হয়েছে, সেই নিয়ে স্থানীয় পুলিশ কিছুই জানে না এটাও সম্ভব নয় বলে তাদের দাবি । তাই দু‘বার আদালত অবমাননার ঘটনা সামনে আসার পর এবার বড়বাজার থানায় এর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হল ।
অন্যদিকে, আর এক ট্রামপ্রেমী এবং সংগঠনের সদস্য সাগ্নিক গুপ্ত জানিয়েছেন, ‘ট্রাম ট্র্যাকের উপরে স্কিড করে বাইক আরোহীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বলে বারবার দাবি করেছে প্রশাসন ৷ এই নিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি আরটিআই করা হয়েছিল ৷ সেই আরটিআই–তে উঠে এসেছে যে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল, এই ১০ বছরের মধ্যে মাত্র একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং একজন মাত্র বাইক আরোহী দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন।’ একইসঙ্গে তিনি এও জানান, ‘ওখানে দুটো লাইন অর্থাৎ চিৎপুরের ট্রামলাইন এবং রবীন্দ্র সরণির ট্রামলাইন একে অপরের উপর দিয়ে গিয়েছে ৷ চিৎপুর রোডে ২০১৭ সালে শেষবার ট্রাম চলেছিল । তারপর সেটি ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর কাজের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় । কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছিল যে, ডালহৌসি মেট্রোর কাজ শেষ হলে পুনরায় চালু হয়ে যাবে ট্রাম । তবে মেট্রোর কাজ শেষ হয়ে গেলেও এখনও সেই রুটটি চালু করা হয়নি ৷ অন্যদিকে, রবীন্দ্র সরণিতে ২০২১ সালের অগস্ট পর্যন্ত ট্রাম চলেছিল । তাছাড়া ওই জায়গাটি বড়বাজার বাণিজ্যিক অঞ্চল । এই অঞ্চলে শুধুমাত্র এমজি রোডে মেট্রো রয়েছে । তাই ওই রুটে ট্রাম পরিষেবা চালু থাকলে ওখানকার ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় মানুষদের যে অনেকটাই সুবিধা হতো সেটা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া বড় ব্যাগ নিয়ে মেট্রোয় ওঠা যায় না, তাই মাত্র সাত থেকে আট টাকায় বড় ব্যাগ নিয়ে ট্রামে চড়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত চলে যাওয়া যেত।’