মেছুয়া বাজার এলাকার ঋতুরাজ হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড উস্কে দিল ২০১০ সালে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট এবং ২০১১ সালে ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের সেই ভয়াবহ স্মৃতি। মঙ্গলবারের এই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ গেছে ১৪ জনের। যার মধ্যে রয়েছেন ১১ জন পুরুষ, ১ জন মহিলা ও এক নাবালক ও নাবালিকা। অগ্নিকাণ্ডে অসুস্থ হয়ে পড়েন মোট ১৩ জন। তার মধ্যে ১২ জনকে হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়েও দেওয়া হয়। এখন একজন ভর্তি রয়েছেন।অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে সিট গঠন করেছে কলকাতা পুলিশ।
কলকাতার জোড়াসাঁকো থানার অন্তর্গত ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত অভিশপ্ত এই বহুতল হোটেল। এই হোটেলে রয়েছে ৪২টি রুম। হোটেলে তিন থেকে ছতলা পর্যন্ত আবাসিকদের থাকার ঘর ছিল। দোতলায় ছিল রেস্তোরাঁ। মঙ্গলবার সন্ধেয় গেস্ট ছিলেন ৮৮ জন। স্টাফের সংখ্যা ৬০ বলে পুলিশ সূত্রে খবর। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে হঠাৎ আগুনের শিখা নজরে আসে পথ চলতি মানুষ থেকে এলাকবাসীর। হোটেলের মধ্যে তখন রয়েছেন হোটেল কর্মী থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন আবাসিকও। এই আবাসিকদের মধ্য়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছিলেন ভিন রাজ্যের বাসিন্দারাও। আচমকা আগুন লাগার ঘটনায় দিশাহারা হোটেল আবাসিকেরা। আতঙ্কে তাঁরা হোটেলের মধ্যে ছুটোছুটি করতে থাকেন। তবে তাঁদের অনেককেই কোনও রকম নড়াচড়ার সময় না দিয়েই ক্ষণিকের মধ্যে সর্বগ্রাসী রূপ নেয় এই আগুন। আতঙ্কিত আবাসিকরা মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন যাতে দ্রুত তাঁদের উদ্ধার করা যায়। এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় দমকলের একাধিক ইঞ্জিন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কর্মীরাও। দমকল আর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কর্মীদের পাশাপাশি আগুনে আটকে থাকা আবাসিকদের উদ্ধারকাজে হাত লাগান স্থানীয় কয়েকজন অকুতোভয় বাসিন্দাও। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কয়েকজন এবং দমকলের কয়েকজন কর্মী আগুনের হাত থেকে হোটেল কর্মী আর আবাসিকদের বাঁচাতে হোটেলের ভেতরে ঢোকেন। প্রাথমিকভাবে মই ব্যবহার করে তিনতলা পর্যন্ত উঠে উদ্ধারকাজ শুরু করেন দমকলকর্মীরা। এদিকে ততক্ষণে হোটেল ঋতুরাজ কার্যতই পরিণত হয়েছে এক জতুগৃহে। বিভিন্ন দিক থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর আগুনের শিখা। এরই মাঝে আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য হোটেলের ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার চেষ্টা করেন হোটেলেরই দুই কর্মী। কিন্তু ভারসাম্য রাখতে না পারায় এক কর্মী সোজা আছড়ে পড়েন মাটিতে। এরপর দ্রুত তাঁকে মেডিক্য়াল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষরক্ষা হয়নি। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে,ঘটনায় এই মৃত ব্যক্তির নাম সঞ্জয় পাসওয়ান। বয়স ৪০। তবে এই বিপদের মাঝেও প্রায় ২৫ জনকে হাইড্রোলিক ল্যাডারের সাহায্যে নামান দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মীরা।
এরপর মধ্যরাত নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে ঘরের ভিতরে তল্লাশিতে ঢোকেন দমকল এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা। তখনই বিভিন্ন ঘর থেকে আরও ১৩টি দেহ উদ্ধার হয়েছে বলে রাত ৩.১৫ নাগাদ জানান নগরপাল মনোজ ভার্মা স্বয়ং। পাশাপাশি আর কোনও দেহ হোটেলের ভিতরে আটকে রয়েছে কিনা তারও খোঁজ চলতে থাকে। এরই মাঝে হোটেল থেকে মোট ২২ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এদের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন হোটেলের ছাদে। সাত জনকে হোটেলের বিভিন্ন ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে অগ্নিদগ্ধ যে দেহগুলি উদ্ধার হয় তা পাঠানো হয় ময়নাতদন্তের জন্য।
প্রাথমিক ভাবে দমকল আধিকারিকরা জানান, আগুনের উৎস এই হোটেলের দ্বিতীয় তল। এদিনের এই ঘটনায় যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের দেহ তিনটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয় ৪ জনের দেহ। তার মধ্যে একজনের নাম জানা গিয়েছে। বছর একষট্টির ওই ব্যক্তির নাম এস মুথ্থু কৃষ্ণন। তিনজনের নাম এখনও জানা যায়নি। এনআরএস হাসপাতালে পাঁচজনের দেহ পাঠানো হয়। তাঁদের প্রত্যেকের নাম জানা গিয়েছে। তাঁদের নাম, দীপ্তেন্দ্র রাম (৪৬), পি রাউত (৩ বছর ৮ মাস), পি দিয়া (৮ বছর), প্রণয় পাঠক (১৩) এবং আরাধ্যা আগরওয়াল (২২)। আরজি কর হাসপাতালে পাঁচজনের দেহ পাঠানো হয়। তার মধ্যে ২ জনের পরিচয় জানা গিয়েছে। একজনের নাম রাজেশ কুমার সান্টুকা। বছর একষট্টির ওই ব্যক্তির বাড়ি ওড়িশায়। অন্যজনের নাম নীরজ কুমার। বছর কুড়ির ওই যুবক বিহারের ভাগলপুরের বাসিন্দা।
এদিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই গোটা ঘটনা প্রসঙ্গে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে গোটা ঘটনায় হোটেলের নিরাপত্তা থেকে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগুন নেভানোর ন্যূনতম ব্যবস্থা ছিল না ৬ নম্বর মদন মোহন বর্মন স্ট্রিটের ওই হোটেলে। পাওয়া যায়নি জল। এলাকার বাসিন্দারা এও জানিয়েছেন, হোটেলে জলের কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। দমকলের লোকজনই বলছে জলের লাইন করা আছে কিন্তু জল ছিল না। বহুতলে যে ট্যাঙ্ক থাকে সেখানে জল ছিল না। যে জল বের হচ্ছিল তাতেও সেরকম চাপ ছিল না। পুরো পাইপ লাইনই খালি। অন্যদিকে ঘটনার পর থেকে হোটেলের মালিককে আর খুঁজে পাচ্ছে না কলকাতা পুলিশ! তাঁর খোঁজে তল্লাশি চলছে বলে জানান কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা।