আর কত প্রাণ যাবে !

আবার একটা বহুতল ভেঙে পড়ল কলকাতার বুকে। এখনও পর্যন্ত মারা গেছেন ১২ জন। কীভাবে এই বহুতল ভাঙল এই প্রশ্ন না করে বরং প্রশ্নটা হওয়া উচিত এতদিন ওই বহুতল তৈরি হয়েছে কী করে? ওরকম এক সংকীর্ণ জায়গাতে কীভাবে গড়ে উঠেছে ছ’তলার বাড়ি তা নিয়ে বিস্মিত মেয়র থেকে মুখ্যমন্ত্রীও। এখন মেয়র বলছেন তিনি জানেন না।কোনও আলাদিনের প্রদীপ ঘষে এই বাড়ি তৈরি হয়নি। ছ’তলা বাড়ি তৈরি হতে সময় লেগেছে। অথচ,  কেউ দেখেননি। স্থানীয় কাউন্সিলর, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা, মেয়র পারিষদ কেউ দেখেননি। এখানেই প্রশ্ন দেখেননি, না দেখতে চাননি? মুখ্যমন্ত্রী ছুটে গেছেন, আহতদের চিকিৎসার হাল হকিকত জেনেছেন, মৃতদের ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন। রাজ্যপালও গেছেন। খুব একটা কথা বলেননি, কিন্তু তাঁর তরফেও ক্ষতিপূরণের ঘোষণা হয়েছে। বিজেপির সজল ঘোষ পুরপিতা হয়েও, ঘটনাস্থলে গেলেন। তাড়া খেলেন। বাজে উদাহরণ হয়ে রইল। এই একই ঘটনা তো কেবল বাংলাতেই ঘটে, তা তো নয়, অন্য জায়গাতেও ঘটে। ভোর রাতেই তো আগ্রাতে কাপড় পট্টিতে বিরাট আগুন লেগেছে, বড় রকমের আগুন, ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। দিল্লিতে বহুতল ভেঙেছে, মনে আছে মুম্বইয়ে বহুতল ভাঙার ছবি, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেবেন্দ্র ফড়নবিশের আবেদন, এটা দুর্ঘটনা, রাজনীতি করবেন না। মনে তো আছেই বাম আমলে মাঝরাতে কুন্দলিয়ার তৈরি বিশাল আবাসন ধসে পড়া। এসব তো হয়েই থাকে। কিন্তু কেন হয় সেটাই প্রশ্ন।

এসব ঘটনা দুর্ঘটনার পরের দিনই খবরের কাগজে কিছু নাম পাওয়া যায়, জানা যায় তাদের কেউ মাছ বিক্রি করতেন, কেউ ট্রেকার চালাতেন, কেউ খালাসি ছিলেন, কেউ বা কেবলই পাড়ার মাস্তান। কিন্তু এরাই শাসকদলের ছত্রছায়াতে ঢুকে পড়েছিল ক’ বছর আগে। তারপর মেটিওরিক রাইজ, উল্কার মতো সোঁ করে আকাশে উঠে পড়া। এসব নামগুলো আগে জানা যায় না। যেমন সন্দেশখালি না হলে আমরা শুদু জানতাম  শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন। এখন জানলাম তার সঙ্গে পিঠে খেতেও ভালোবাসতেন।

এই খিদিরপুরের ক্ষেত্রে তেমন এক নাম হল মহম্মদ ওয়াসিম। ইনি এলাকাতে শাসক ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত। এরপর তিনি উধাও হবেন, কিছুদিন পরে ধরা পড়বেন, আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসবেন, তারপর চুপ করে বসে থাকবেন। আবার অন্য আরেকজনের জন্ম হবে। ওই এলাকার কাউন্সিলর শামস ইকবাল, তিনি পাঁচ কোটি টাকার অ্যাস্টন মার্টিন গাড়ি চড়ে পুরসভার বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন, উনিও কিছুই জানেন না। মৃত লোকগুলো কি কবরে গিয়ে জানতে পারবে যে তাদের মৃত্যুর জন্য মাথা পিছু কত টাকা দেওয়া হল। অন্তত ঘোষণা হল। এদিকে বেড়েছে কর্মতৎপরতা। ছোট লাল বাড়িতে নিত্যদিন ডাক পড়ছে অনেকেরই। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে এই তালিকা।

এই তো আমরিতে আগুন লেগেছিল। মানুষ মারা গেল। ক’জনের জেল হয়েছে? ফাঁসি হয়েছে? কুন্দলিয়ার কী হয়েছে? ব্রিজ ভেঙে পড়েছে পোস্তায়, মানুষ মারা গেছেন, কী হয়েছে, বড়বাজারে আগুন লেগেছে, মঙ্গলাহাটে আগুন লেগেছে, কোথাও কিছু হয়নি। কিছু হয় না বলেই আবার সেই একই ঘটনা ঘটে, এবং ঘটনার পরে কিছু দেবশিশুদের দেখা যায়, যাঁরা আসেন অবাক হন, ক্রুদ্ধ হন, সবকটাকে জেলে পাঠাব বলে চলে যান। তারপর আবার ঘটনা ঘটের। বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর, বলেছিলেন নাজিম হিকমত, আর সেই বিংশর পরে আরও কত বছর কেটে গেছে, কাজেই এখন শোকের আয়ু মালা শুকানোর আগেই শেষ, তারও আগে চাপা পড়ে যায় তদন্ত। সঙ্গে সঙ্গে একটা ফাটা রেকর্ডের মতো ৩৪ বছরের ঘটনার কথা উঠে আসছে, সেই ৩৪ বছরে বহু অন্যায়ের জন্যই তো তারা এখন শূন্য। হয়তো আমজনতাও চলেছেন সেই পথেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × four =