ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে বাংলায় কতটা সোচ্চার বিরোধীরা, প্রশ্ন থেকেই গেল

দেশ জুড়ে চলছে নির্বাচনী মহোৎসব। ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনে যে ক’টি ইস্যুকে সামনে রেখে বিরোধীরা কেন্দ্রের শাসককে বিঁধতে পারতেন, তার মধ্যে একটি অবশ্যই ইলেক্টোরাল বন্ড। এখনও আমজনতার অনেকেই জানেন না, এই ইলেক্টোরাল বন্ড খায়, না মাথায় দেয়। আদতে ২০১৭ সালে বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি এই ইলেক্টোরাল বন্ড আনার কথা ঘোষণা করেন। এরপর ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় এই বন্ডের ব্যবহার। খুব সহজ কথায় বলতে গেল, ইলেক্টোরাল বন্ড এক ধরনের দলিল। কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিতে চাইলে, তিনি ব্যাঙ্ক থেকে বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলের হাতে তুলে দিতে পারেন। এরপর সেই রাজনৈতিক দল তার নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে এই বন্ড ভাঙিয়ে নেবে, এটাই স্থির হয়। তবে এই বন্ড কে বা কারা কিনছেন, তাঁর পরিচয় সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখা হবে বলেও বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন অরুণ জেটলি। সঙ্গে এও জানিযেছিলেন ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লক্ষ, ১০ লক্ষ ও ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড পাওয়া যাবে। তবে শর্ত একটাই, হাতে পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলিকে এই বন্ড ভাঙিয়ে নিতে হবে। আর এই বন্ড মিলবে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে। এই বন্ডের ক্ষেত্রে সরকারের দাবি ছিল, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা কমাতে এবং অনুদানের মাধ্যমে কালো টাকার আদানপ্রদান রুখতে উপযোগী হবে ইলেক্টরাল বন্ড। কারণ, নগদে লেনদেন হলে রাজনৈতিক দলগুলি সরাসরি নগদে অনুদান নিলে এর মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা কালো টাকা সাদা করে ফেলছে। যদিও বিরোধী দলের অবস্থান ছিল ঠিক এর বিপরীতে। তাঁদের তরফ থেকে দাবি করা হয়, এতে অস্বচ্ছতা আরও বাড়বে। বিশ্বের কোনও দেশেই এমন ব্যবস্থা নেই, যেখানে বন্ড ভাঙাচ্ছে রাজনৈতিক দল। ফলে কোন কর্পোরেট সংস্থা কাকে ভোটে সাহায্য করছে, তার বিনিময়ে সরকারের থেকে কী সুবিধে আদায় করছে, তাও বোঝার উপায় থাকবে না। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই ইলেক্টোরাল বন্ডকে এতদিন নির্বাচনী সংস্কারের ক্ষেত্রে মোদি সরকারের মাস্টারস্ট্রোক হিসাবে দেখা হত। তবে আরও নজরে পড়ার মতো ঘটনা হল, গত পাঁচ বছরে ইলেক্টোরাল বন্ডে বিরোধীদের থেকে কয়েক গুণ বেশি চাঁদাও পেয়েছে গেরুয়া শিবিরই।

এরপর বিরোধীরা শীর্ষ আদালতের শরনাপন্ন হলে বিরোধীদের যুক্তিতেই সিলমোহর দেয় আদালত। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য যে, তাদেরও আশঙ্কা, বন্ডের মাধ্যমে এভাবে অনুদান দেওয়ার মধ্যে পালটা সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। বস্তুত, কর্পোরেটরা অনুদানের বিনিময়ে পালটা অনৈতিক সুবিধা প্রত্যাশা করে। এরপরই প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের  নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে জানিয়ে দিয়েছে, মোদি জমানায় চালু হওয়া ইলেক্টোরাল বন্ড অসাংবিধানিক। দ্রুত সেটা বন্ধ হওয়া উচিত। তবু এই ইলেক্টারাল বন্ড নিয়ে বিরোধী শিবির থেকে কেন্দ্রকে য়ে ভাবে বিদ্ধ করা উচিত ছিল তা কিন্তু নজরে এল না ২০২৪-এ। অন্তত বাংলায় তো নয়ই।

একটু তলিয়ে ভাবলেই এটা স্পষ্ট হয় যে, ইলেকটোরাল বন্ডের বিষয়টা শুধুমাত্র একটা স্বতন্ত্র কেলেঙ্কারি নয়। এই বন্ডের মাধ্যমে বড় কোম্পানি আর শাসকদলগুলির বিভিন্ন লেনদেনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে আরও অনেক কেলেঙ্কারি। এক রাশ আর্থিক দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি আর কালো টাকা সাদা করার ঘটনার সমাহার ঘটেছে ৫ বছর ধরে। তাই এটা একটা ‘মেগা স্ক্যাম’ বা মহা-কেলেঙ্কারি। ইলেক্টারাল বন্ড নিয়ে প্রথমত যে প্রশ্নটা আসছে তা হল, কেবলমাত্র ক্ষমতাসীন দলগুলিকেই যদি মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়ে থাকে তাকে আর ‘চাঁদা’ বলা চলে কি না। যে কোম্পানিগুলি বড় অঙ্কের ‘চাঁদা’ দেওয়ার তালিকার উপরের দিকে, তাদের বিভিন্ন তথ্য ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে। ইডি, সিবিআই বা আয়কর দফতরের তদন্তও চলছে। তারা হানা দিয়েছে এইরকম ২২টি কোম্পানির ক্ষেত্রে সর্বসাকুল্যে ৪৮০০ কোটি টাকা ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে দিয়েছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ বা ১৯১৯ কোটি টাকা একাই পেয়েছে বিজেপি।

এই তালিকায় নজর রাখলে দেখা যাচ্ছে, তদন্তাধীন কর্পোরেট গ্রুপ বা সংস্থাগুলির মধ্যে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে হায়দরাবাদের পিপি রেড্ডি এবং কৃষ্ণ রেড্ডির সংস্থা মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানি, কলকাতার মহেন্দ্র কুমার জালান এন্টারপ্রাইজেস বা কেভেন্টার্স গ্রুপ, অনিল আগরওয়ালের বেদান্ত গ্রুপ, দিল্লির কুশলপাল সিংহের ডিএলএফ গ্রুপ, ‘লটারি বাদশা’ সান্তিয়াগো মার্টিনের ফিউচার গেমিং প্রাইভেট লিমিটেড আর সঞ্জীব গোয়েঙ্কার হলদিয়া এনার্জি লিমিটেড। কেবল বিজেপি নয়, জাতীয় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে এবং ভারত রাষ্ট্র সমিতির মতন দলগুলিও এই তদন্তাধীন সংস্থার থেকে ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে টাকা পেয়েছে। যদিও এই টাকার অঙ্ক বিজেপির তুলনায় অনেক কম।

আর এখানেই বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, আসলে চাঁদা নয়, কেন্দ্রীয় এজেন্সিদের তদন্ত থেকে বাঁচানোর বিনিময়ে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়া হয়েছে। এদিকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি মোদি সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে লেলিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীদের থেকে তোলাবাজির অভিযোগও তুলেছেন। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ঘুষ দিয়ে বিদ্যুৎ, সড়ক বা আবাসন নির্মাণ ইত্যাদি পরিকাঠামো প্রকল্পে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার বরাত বা অন্যান্য সরকারি সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ সহ অভিযোগও উঠেছে। আর এই তালিকায় রয়েছে মহারাষ্ট্রের বিজি শিরকে গ্রুপ, হায়দ্রাবাদের মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গ্রিনকো গ্রুপ, আহমেদাবাদের টরেন্ট গ্রুপ এবং দীনেশচন্দ্র আর আগরওয়াল ইনফ্রাকন প্রাইভেট লিমিটেড, লখনউ-এর অ্যাপকো ইনফ্রাটেক এবং সুনীল মিত্তলের ভারতী গ্রুপের বিরুদ্ধে।

শুধু তাই নয়, ভুয়ো কোম্পানি মারফত কালো টাকা সাদা করার প্রাথমিক প্রমাণও মিলেছে। কোম্পানি আইনের ১৮২ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনও নতুন কোম্পানি তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগে রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিতে পারে না। অথচ এমন অন্তত ২০টি কোম্পানির হদিশ পাওয়া গেছে যারা তিন বছর পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে সবমিলিয়ে ১০০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা দিয়েছ। যার মধ্যে ৩১ কোটি টাকা পেয়েছে ভারত রাষ্ট্র সমিতি আর ২৬ কোটি টাকা গেছে বিজেপি-র কাছে।

এখানে আরও একটা তথ্য দেওয়া প্রয়োজন।কোম্পানি আইনের ১৮২ নম্বর ধারায় কোনও কোম্পানির রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া মোট বার্ষিক চাঁদার ক্ষেত্রে বিগত তিন বছরের নিট মুনাফার ৭.৫ শতাংশের বেশি হতে না পারার যে সীমারেখা রাখা হয়েছিল, তা ২০১৭ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে মোদি সরকার তুলে দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই সীমানহীন চাঁদা দেওয়ার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিয়ে তিন বছরের নিট মুনাফার ৭.৫ শতাংশের সীমাকে পুনর্বহাল করে। এদিকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগের দুই বছরে, অর্থাৎ ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে, অন্তত ৫৫টি কোম্পানি এই ৭.৫ শতাংশের সীমা উল্লঙ্ঘন করে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিয়েছে, এমন প্রমাণও মিলেছে। এই দুই অর্থবর্ষে দেওয়া মোট চাঁদার পরিমাণ ১৯৯৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১৩৭৮ কোটি টাকা ওই ৭.৫ শতাংশের সীমা বহির্ভূত চাঁদা। এই ৫৫টি কোম্পানির দুই বছরে বিজেপিকে দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ১৪১৪ কোটি টাকা।

এর আরও গভীরে ঢুকতে গেলে ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে প্রত্যেকটি বড় লেনদেনের আলাদা করে তদন্ত করতে হবে। জটিল এবং বেআইনি লেনদেনের তদন্তে বিভিন্ন তদন্তারী সংস্থাদের সম্মিলিতভাবে টিম হিসেবে কাজ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে একটা বিশেষ তদন্তকারী দল বা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করেই ইলেকটোরাল বন্ড স্কিমের মতন মহা-কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে ন্যায় এবং সুবিচার সুনিশ্চিত করা যেতে পারে। সবশেষে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে, এতো বড় স্ক্যামের ক্ষেত্রে আমারা বাংলা থেকে কী দেখতে পেলাম বিরোধীদের তেমন ভাবে সোচ্চার হতে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three + four =