ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হলে আমজনতার ভবিষ্যত

কেন্দ্রে যে বিজেপি সরকার রয়েছে তার চাবিকাঠি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হাতে। এই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জন্মই হয়েছিল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে। এখন কথা হল হিন্দুরাষ্ট্র মানে কী? পৃথিবীতে এমন অনেক দেশই আছে, যেখানে অন্যান্য বিদ্যমান ধর্মের তুলনায় একটি বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয় অথবা যাদের বলা হয় ধর্মতান্ত্রিক দেশ। অবশ্য তার ফলে সেইসব দেশের শ্রেণিপ্রকৃতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটে না। একইভাবে ভারতে যদি হিন্দুরাষ্ট্র আদৌ বাস্তবায়িত হয়, তবে সেক্ষেত্রে ভারতরাষ্ট্রের কর্ণধাররা অন্যান্য ধর্মের নিপাত কামনা করে সোচ্চারে হিন্দু ধর্মের জয়গান গাইতে পারে। তবে তার ফলে ভারতরাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্রের কোনও বদল ঘটবে না। বরং ভারতে একচেটিয়া পুঁজির নতুন এবং আরও আগ্রাসী এক প্রজন্মের দ্বারা অনুমোদিত সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্রই থেকে যাবে। এর কারণটি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের সভাপতি জর্জি দিমিত্রভ সপ্তম কংগ্রেসে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে ‘লগ্নিপুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে প্রতিশোধপরায়ণ অংশের সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্র।’ সেখানে হিন্দুরাষ্ট্র যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সেটি আদতে হবে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র।

ফলে তখন ভারতে যাবতীয় সরকারি অনুষ্ঠান হিন্দু দেবতাদের পুজার্চনার দ্বারা আরম্ভ হবে। সমস্ত রাস্তা, রেলওয়ে স্টেশন অথবা শহরগুলির নাম, যা এখন মধ্যযুগের সম্রাট-মহারাজাদের নামে নামাঙ্কিত তা বদলে হিন্দুত্ববাদের প্রতীকি দেবতা, রাজার নামে নামাঙ্কিত করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব অনুষ্ঠান শুরু হবে সরস্বতী বন্দনা দিয়ে। এর পাশাপাশি সরকারি অর্থে বহু মন্দির নির্মাণ করা হবে। কিন্তু এসবের কোনওটার দ্বারাই গড়পড়তা হিন্দু জনতার জীবনধারণের মানের একবিন্দুও উন্নতি হবে কি না তা নিয়ে থাকছে বড় এখটা প্রশ্ন চিহ্ন।  এখানে তুলে ধরা যেতে পারে তুরস্কের এরদোগান সরকারের কথা। যখন ইসলামি সেন্টিমেন্টকে তোষণ করার উদ্দেশ্যে বিখ্যাত হাজিয়া সোফিয়া চার্চটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করে, তাতে আম- তুরস্কবাসী নাগরিকদের জীবনযাত্রা বিন্দুমাত্র উন্নতি কিন্তু ঘটেনি।

এই মুহূর্তে যে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর দ্বারা এখন শাসিত হচ্ছি তার অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে। দেশের বেকারত্ব বহু দশকের মধ্যে এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। সেন্টার ফর মনিটরিং দ্য় ইন্ডিয়ান ইকনমির সমীক্ষা অনুসারে ভারতে বেকারত্বের হার ২০০৮-২০১৯ সালের মধ্যে মোট সক্রিয় শ্রমশক্তির গড়ে ৫ এবং ৬ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করত। কিন্তু তা এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশে। হিন্দুত্ববাদীদের সরকার বেকারত্বের এই ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য কোনও রকম পদক্ষেপ করা তো দূর-অস্ত, বরং সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সরাসরি বলেই দিচ্ছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার ব্যাপারে সকারের কিছু করার নেই। পরবর্তীকালে উক্ত আধিকারিক এই মন্তব্য প্রত্যাহার করেননি তো বটেই এমনকি সরকারের কোনও কর্তাব্যক্তিও এই মন্তব্যকে মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার ব্যক্তিগত মতামত বলে ড্যামেজ কন্ট্রোলের কোনও চেষ্টাও করেননি। ফলে এর থেকে স্পষ্ট কাজের সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে এটাই সরকারের অবস্থান ঠিক কি। শ্রমজীবী জনতার প্রত্যহ বেড়ে চলা দুর্দশার পেছনে কাজের অভাবের যে  জ্বলন্ত ইস্যুটি রয়েছে, সে-সম্পর্কেও সরকার কতটা উদাসীন তা বোঝা যাচ্ছে প্রতিনিয়তই।

এসব ঘটনার মধ্য়ে দিয়ে যে বাস্তব ঘটনার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা তাতে এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, হল বর্তমান সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন শ্রমজীবী জনতার দুর্দশা লাঘবের কোনও আশা নেই। পরিবর্তে জালিয়াতি করা তথ্য-পরিসংখ্যানের ওপরে ভিত্তি করে তৈরি করা উচ্চহারের জিডিপির বিকাশের ফেটে যাওয়া কাঁসরটা সরকার এবং তাদের অনুগতরা বাজিয়েই যাবেন। জিডিপির বিকাশের এই সন্দেহজনক উচ্চহারকে হাতিয়ার করে সরকার তখন দেশের ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ একচেটিয়া পুঁজিকে নানারূপ বদান্যতায় ভরিয়ে দেবে। অন্যদিকে যারা নিরপেক্ষ পরিসংখ্যান তুলে ধরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে মানুষের দুর্দশা কীভাবে বেড়ে চলেছে, তাঁদের দেশদ্রোহী আখ্যায় ভূষিত করা হবে। এই যদি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা পরিচালিত সরকারের কার্যক্রম হয়, তবে এ-কথা সহজেই অনুমান করা চলে যে ভবিষ্যতে কোনও হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা মানুষের বস্তুগত জীবনের দুর্দশা মোচন করার সরকারি কর্তব্যকে প্রাতিষ্ঠানিক ঔদাসীন্যের কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × three =