উগ্র হিন্দুত্ববাদ না পসন্দ ভারতবাসীর

গত কয়েক বছর ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদের আঘাত-আস্ফালন বারবার যেন চিড় ধরাতে চাইছে ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ এক দেশের ধর্মীয় সহাবস্থানে। সংবিধানে ভারত  ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় প্রকল্প উদ্বোধন থেকে শুরু করে নানা সরকারি কার্যকলাপে স্বাধীন ভারতে বহুবারই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মটির রীতিনীতি পালিত হতে দেখা গেছে। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠিত হওয়ার পর এই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রাবল্য বড় বেশি প্রকট হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে স্বয়ং হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠায় মেতে উঠতে। এরই পাশাপাশি কে কী খাবে, কী পরবে এমন ব্যক্তিগত বিষয়েও জারি হতে দেখা যাচ্ছে সরকারি ফতোয়া। বিজেপিশাসিত রাজ্যে গোমাংস রাখার অজুহাতে যখন তখন স্রেফ সন্দেহের বশে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা তো আছেই। আর অন্যদিকে পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় অবাধে পার পেয়ে যাচ্ছে দাঙ্গাবাজ হিন্দুত্ববাদী নেতা। সেখানে স্রেফ সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষ হওয়ার অপরাধে পুলিশ-প্রশাসনের কোপে পড়তে হচ্ছে নিরীহ মানুষকে। প্রকাশ্য সমাবেশে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানিয়ে তোলার হুঙ্কারও শোনা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতা থেকে অত্যন্ত ছোট খাটো নেতাদের গলাতেও। সব মিলিয়ে এ-দেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুপরিচিত সুদীর্ঘ ঐতিহ্যে এক ফাটল ধরানোর যে অপচেষ্টা তা প্রকট। আশঙ্কা আতঙ্ক যেন শ্বাসরুদ্ধ করতে বসেছে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ধর্মনিরপেক্ষ শান্তিপ্রিয় ভারতীয়দের।

এখানেই সেই লাখ টাকার প্রশ্নটাই মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তাহলে কি সত্যিই দেশে ধর্মীয় সহনশীলতা আজ বিপন্ন? সত্যিই কি ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-এর স্লোগানে সোচ্চার হয়ে উঠতে চাইছেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ? তবে সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা স্পষ্ট  বার্তা দিয়েছে-‘না’। তাদের রিপোর্ট বলছে, আজও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভারতকে শুধু হিন্দুদের নয়, সমস্ত ধর্মের মানুষেরই দেশ বলে মনে করেন।

এখানে বলে রাখ শ্রেয়, এই সমীক্ষাটি করা হয়েছে লোকনীতি-সিএসডিএস-এর তরফ থেকে। সমীক্ষা-রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ৭৯ শতাংশই মনে করেন, ভারত শুধু হিন্দুদের নয় সমস্ত ধর্মের মানুষেরই দেশ। তাঁরা জানিয়েছেন, সমস্ত ধর্মের মানুষের নিজের নিজের ধর্ম পালন করার অধিকার অবশ্যই রয়েছে এদেশে।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী মানুষদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কারও মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাঁরা ভাবতে পারেন, সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষের কাছে এই উত্তরই তো প্রত্যাশিত। এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলতেই হয়, মুসলমান বা অন্য সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষই শুধু নয়, হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী অধিকাংশ মানুষও জানিয়েছেন এ-দেশ সব ধর্মের মানুষের বাসভূমি। দেখা যাচ্ছে প্রতি ১০ জনে ৮ জন হিন্দুই ভারতের ধর্মীয় সহনশীলতায় প্রবলভাবে বিশ্বাসী। মাত্র ১১ শতাংশ হিন্দু ধর্মের মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন ভারত শুধু হিন্দুদেরই।

এই সমীক্ষায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, প্রবীণদের তুলনায় তরুণরা আরও বেশি করে ভারতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থানে আস্থা রাখেন। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সি তরুণ-তরুণীদের ৮১ শতাংশই বিশ্বাস করেন ভারত সমস্ত ধর্মের মানুষের দেশ। আবার ৫৬ বছর ও তার বেশি বয়সের ৭৩ শতাংশ মানুষও এই ভাবনাতেই আস্থাশীল।

শুধু তাই নয়, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি যাঁদের, এমন ৭২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন ভারত কখনও শুধু হিন্দুদের দেশ হতে পারে না। আর যাঁরা পড়াশোনার এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের ৮৩ শতাংশই মনে করেন, ভারত সব ধর্মের মানুষের নিরাপদ বাসভূমি।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামায় সাধারণত শহরগুলিকেই আক্রান্ত হতে দেখা যায় বেশি। তা সত্ত্বেও এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, গ্রামের তুলনায় শহর এবং বড় শহরগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দেশের ধর্মীয় সহনশীলতায় অনেক বেশি ভরসা রাখেন। রিপোর্ট বলছে, গ্রামগুলির ৭৬ শতাংশ এবং শহর ও বড় শহরগুলির যথাক্রমে ৮৫ ও ৮৪ শতাংশ মানুষ ভারতকে সমস্ত ধর্মের মানুষের দেশ বলে মনে করেন।

দেশের রাজনীতির অঙ্গনে আজ যখন ধর্মের নামে অন্ধতার প্রবল দাপাদাপি, ক্ষমতার নেশায় উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষে যখন প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণে সার-জল ঢালা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি-মূল্যবোধ তো দূর, যখন মানবিক অনুভূতিগুলিকেও গলা টিপে মারতে চাইছে মতলববাজ একদল উগ্রবাদী, তখন লোকনীতি-সিএসডিএস-এর এই সমীক্ষা প্রাণে আশা জাগায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + twenty =