২০৩০ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে বলে জানিয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস। সঙ্গে এও জানানো হয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই জায়গা পাকাপাকিভাবে ভারতের হয়ে যাবে। সম্প্রতি ‘লুক ফরয়োর্ড এমার্জিং মার্কেটস: আ ডিসাইসিভ ডিকেড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসঅ্যান্ডপি এমনই এক পূর্বাভাস দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এই প্রতিবেদনে তারা এও বলেছে, ভবিষ্যতে উদীয়মান অর্থনীতিগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল ভূমিকা পালন করবে। এখন থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে উদীয়মান দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধির হার ৪.০৬ শতাংশে উন্নীত হবে, যেখানে উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার ১.৫৯ শতাংশে নেমে আসবে। আর এখানেই ভারতের ভূমিকা হবে নেতৃস্থানীয়। এদিকে এরই মাঝে মঙ্গলবারই রিপোর্ট আসে এনএসও-র। যেখানে বলা হয়, চলতি অর্থবর্ষে দেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৬.৪ শতাংশে। এদিকে গত অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ। অর্থাৎ, গতবারের তুলনায় প্রায় ২ শতাংশ কমছে বৃদ্ধির হার। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা শ্রেয়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষ শেষ হবে মার্চে। তার আগে, ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হওয়ার কথা। জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর বা এনএসও’র এই তথ্য বাজেট পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকেরিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমান ছিল চলতি অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৬.৬ শতাংশে। কিন্তু এনএসও তার চেয়েও কম, ৬.৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধির অনুমান করেছে।
চলতি অর্থবর্ষের প্রথম অগ্রিম অনুমান রিপোর্ট জানিয়েছে প্রকৃত মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার হবে ৬.৪ শতাংশ। তবে টাকার চলতি মূল্যে হিসেব করলে বৃদ্ধির হার হবে ৯.৭ শতাংশ। আগের অর্থবর্ষ, ২০২৩-২৪, চলতি মূল্যে বৃদ্ধির হার ছিল ৯.৬ শতাংশ। এই হিসেবেও বোঝা যাচ্ছে মূল্যবৃদ্ধির হার দেশে চড়া।
সূত্রে এ খবরও মিলছে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে বাজেট সংক্রান্ত প্রস্তাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি। পাশাপাশি সরকারি শূন্যপদ পূরণ, স্থায়ী চাকরিতে জোর দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। আর এখানেই
এনএসও’র অনুমান, চলতি অর্থবর্ষে কৃষি এবং কৃষি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৩.৮ শতাংশে। আগের অর্থবর্ষে এই হার ছিল ১.৪ শতাংশ। নির্মাণ শিল্পে অনুমান ৮.৬ শতাংশ। গত অর্থবর্ষে ছিল ৭.৩ শতাংশ।
বেসরকারি ভোগব্যয় বৃদ্ধির হার ৭.৩ শতাংশ হবে বলে অনুমান রিপোর্টে। আগের অর্থবর্ষে এই হার ছিল ৪ শতাংশ। সরকারি ভোগব্যয় বা সামাজিক ক্ষেত্রে পণ্য ও পরিষেবা কেনার জন্য সরকরের ব্যয় বৃদ্ধির হার ২.৫ শতংশ থেকে বেড়ে ৪.১ শতাংশ হবে বলে অনুমান। এর আগে জুলাই-সেপ্টেম্বর, এই তিন মাসে বৃদ্ধির হার কমে ৫.৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ফলে বার্ষিক বৃদ্ধির হারের অনুমান রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ৭.২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৬ শতাংশ করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
এনএসও’র অনুমান, প্রকৃত জিডিপি বা মোট জাতীয় উৎপাদন দাঁড়াবে ১৮৪.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা। এই হিসেবে টাকার অঙ্কে বৃদ্ধিকে গণনা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ফলে পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনে প্রকৃত বৃদ্ধি বোঝা যায়। টাকার অঙ্ক ধরে জিডিপি হবে ৩২৪.১১ লক্ষ কোটি টাকা।
এরই রেশ টেনে এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক কেমন ছিল ২০২৪ সালে ভারতীয় অর্থনীতি। এই বছর অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত যে খুব একটা সহজ জায়গায় ছিল তা মোটেই বলা যায় না। উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় মুদ্রাস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এর প্রভাব বিনিয়োগেও দৃশ্যমান ছিল। প্রথম প্রান্তিকে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কারণে সরকারি ব্যয় এখনও পর্যন্ত কিছুটা ধীরগতির। এই কারণে, এই বছর মূলধন ব্যয় (ক্যাপেক্স) লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হতে পারে। অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও অস্থিরতা রয়েছে, যার কারণে ভারতের রপ্তানির প্রবৃদ্ধি মন্থর ছিল। এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ২০২৫ অর্থবছরে ভারতীয় অর্থনীতি ৬.৬-৬.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে আশা করা হচ্ছে এই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, যা সাধারণ মানুষ এবং কোম্পানি উভয়কেই স্বস্তি দেবে।
পাশাপাশি এও জানানো হয়েছে, খরিফ ফসল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্ষার পরে জলাধারগুলি কানায় কানায় ভরাট হয়ে রবি শস্যকেও সাহায্য করবে। এতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনযাত্রায়। এর ফলে ২০২৪-এ সালে যে চাপ ছিল তা দূর হবে। শুধু তাই নয়, জিডিপি-র ৪.৫ শতাংশ রাজস্ব ঘাটতির যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে কেন্দ্রের তাও অর্জন করবে।
প্রকৃতপক্ষে, ২০২৫ অর্থবছরে ঘাটতি ৪.৭-৪.৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এই পরিসংখ্যানটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আগামী তিন বছরে ৩ শতাংশ লক্ষ্য অর্জনের পথ প্রশস্ত করবে। এত কিছুর পরেও সরকার যে কোনও ঘাটতি পুষিয়ে নিতে মূলধন বিনিয়োগ করতে পারে।
এদিকে ব্রিটেনের সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)-এর রিপোর্টে জানিয়েছিল ২০২৫-এর মধ্যে ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার পঞ্চম বৃহত্তম দেশ হবে, পিছনে ফেলবে ব্রিটেনকে। একইসঙ্গে ওই রিপোর্টে এও দাবি করা হয়েছিল, ২০৩০-এর মধ্যে ভারত উঠে আসবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি দেশ হিসেবে। সিইবিআর-এর বার্ষিক রিপোর্ট এও বলেছিল, করোনার জেরে ভারতীয় অর্থনীতি কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে ঠিকই, ফলে ২০১৯-এ ব্রিটেন আমাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে। করোনার সময়ে ২০২০-তেও টাকার মূল্য কমে যাওয়ায় তারা এগিয়ে রয়েছে। ২০২৪ পর্যন্ত এভাবেই ব্রিটেন আমাদের আগে থাকবে। তারপর আবার টপকে যাবে ভারত। ২০২১-এ ভারতীয় অর্থনীতি ৯ শতাংশ বাড়বে, ২০২২-এ বাড়বে ৭ শতাংশ। তখন থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকবে আর্থিক বৃদ্ধি। কারণ দেশ যত আর্থিকভাবে উন্নত হবে, তত স্বাভাবিক নিয়মেই বৃদ্ধি কমতে থাকবে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩৫-এ ভারতের বার্ষিক বৃদ্ধি কমে হতে পারে ৫.৮ শতাংশ। ২০৩০-এর মধ্যে ভারত হয়ে উঠবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০২৫-এ ব্রিটেনকে টপকে যাওয়ার পর ২০২৭-এ টপকে যাবে জার্মানিকে আর ২০৩০-এ জাপানকে, এমনটাই জানিয়েছিল সিইবিআর রিপোর্ট। এই রিপোর্ট আরও বলেছিল যে, ২০২৮-এ চিন আমেরিকাকে টপকে হয়ে উঠবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি।
এদিকে ট্রেন্ড যা বলছে তাতে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থ বছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৭ শতাংশ। মূলত গ্রামাঞ্চলের চাহিদা বৃদ্ধির জেরে দেশটির প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগতে পারে বলে জানিয়েছে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়। এদিকে গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপির সূচক মধ্যম সারিতে থাকলেও তৃতীয় প্রান্তিকের পর থেকে তা উল্লেখযোগ্যহারে বাড়বে। এই হারে জিডিপি বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে ভারত দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতির তকমা ধরে রাখতে পারবে বলে আশা বিশেষজ্ঞদের। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) একই কথা বলেছে। অক্টোবরে তারা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, চলতি অর্থবর্ষে (২০২৪-২৫) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হতে পারে ৭ শতাংশ। পরামর্শক সংস্থা ডেলয়েট ইন্ডিয়া জানিয়েছে, এ বছর ভারতের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ থেকে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
এরপর নভেম্বরে মাসিক পর্যালোচনার পর ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্রামাঞ্চলের চাহিদায় স্থিতিশীলতা এসেছে। একই সঙ্গে শহরের ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দুই ও তিন চাকার গাড়ি বিক্রি এবং দেশীয় ট্র্যাক্টর বিক্রির প্রবণতা দেখে এই ধারণা করছে তারা। একইসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় এও জানিয়েছে, যাত্রীবাহী গাড়ি বিক্রি অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মোট ১৩. ৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে বিমান পরিষেবার পরিসংখ্যান দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিমান পরিবহণে যাত্রী সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে । এতে বোঝা যাচ্ছে, শহরাঞ্চলের মানুষের চাহিদা বেড়েছে। এছাড়াও এবারের বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার প্রভাবে ফলন ভালো হয়েছে। জিডিপির জন্য তা আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। এদিকে বিশ্ববাজারেও তেলের দাম আবার বেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ভারতের উৎপাদন খাতে গতি এসেছে। এ ছাড়া ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ভারতের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে ২০২৪-এর নভেম্বরে বিশ্ব অর্থনীতির নতুন মানচিত্র তৈরি করতে চলেছে ভারত, এমনটাই জানানো হয় জাপানি গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) শীঘ্রই জাপানকে ছাড়িয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির স্থান দখল করতে চলেছে। জাপান টাইমস-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বিষয়টি তুলেও ধরা হয়, সেখানে জাপানের অর্থনীতিবিদরা এই সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেন।
জাপান টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, আইএমএফ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৫ সালেই ভারত জাপানকে টপকে চতুর্থ স্থানে উঠে আসতে পারে। তবে ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান মার্সেল থাইলিয়ান্ট বলেছেন যে, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক ঘটনাবলির প্রভাবের কারণে এই স্থানবদল আরও তাড়াতাড়ি ঘটতে পারে।
ভারতীয় অর্থনীতি বর্তমানে বৈশ্বিক দৃষ্টিতে অন্যতম দ্রুতগতির অর্থনীতির একটি উদাহরণ। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, এবং শক্তিশালী ভোক্তা চাহিদার কারণে দেশটির জিডিপি ক্রমাগত বাড়ছে। এই প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের বিশাল জনসংখ্যা এবং দ্রুতগামী অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে জিডিপি বৃদ্ধির হার আরও ত্বরান্বিত হবে। ভারতের জিডিপি বর্তমানে প্রায় ৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। জাপানের জিডিপি ৪.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তবে ভারতের বর্তমান বৃদ্ধির হার বজায় থাকলে এটি শীঘ্রই জাপানের বর্তমান স্তর ছাড়িয়ে যাবে। অন্যদিকে, জাপানের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে চলছে। বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, জনসংখ্যা হ্রাস এবং শ্রমশক্তির অভাব জাপানের অর্থনৈতিক গতিকে কমিয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে পারলে উন্নত দেশগুলির স্থান দখল করা সহজ হবে। এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, ভারতীয় তথ্য প্রযুক্তি খাত বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ। বিশেষ করে যেখানে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, ইনফোসিস, উইপ্রোর মতো সংস্থাগুলি ভারতের প্রযুক্তি খাতের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে। এর পাশাপাশি ভারতে একটি বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে যা এক স্থায়ী চাহিদা তৈরি করে। এদিকে আবার ভারত সরকার বেশ কিছু উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যেমন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, যা দেশের উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করছে। ভারতের বিশাল জনসংখ্যা, বিশেষত তরুণ জনগোষ্ঠী, অর্থনীতির জন্য একটি বড় পুঁজি হিসেবে কাজ করছে। জাপানের বৃদ্ধ বয়সের জনগোষ্ঠীর তুলনায় এটি ভারতের জন্য একটি বড় সুবিধা। তবে ভারতের অর্থনৈতিক উত্থানে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ভারত এখনই বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ। দিনে দিনে জনসংখ্যা আরও বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে এসঅ্যান্ডপি বলছে, সেটাই হবে ভারতের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। ক্রমবর্ধমান নাগরিকদের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিষেবা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এসঅ্যান্ডপি এটাই মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যেভাবে ভারতের জনসংখ্যা বাড়ছে, তা দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। পরিষেবা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আরেক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিজের বক্তব্য, জনসংখ্যা ও মানুষের জীবনমান বৃদ্ধির কারণে জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত গাড়ি বিক্রি বাড়বে। এতে ভারতের কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার কর্মসূচি চাপে পড়তে পারে। এর পাশাপাশি ভারতের গ্রামীণ এলাকাগুলিতে এখনও অবকাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে, যা প্রবৃদ্ধিতে বাধা তৈরি করতে পারে। একইসঙ্গে শিক্ষার অভাব এবং দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক বাণিজ্য ও কূটনীতিক সম্পর্ক ভারতের অর্থনৈতিক গতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে ভারতের স্থান পঞ্চম। তবে ভারত জার্মানিকে টপকে খুব দ্রুতই চতুর্থ স্থান অর্জন করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনীতির সঙ্গে ভারত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় সুযোগ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা।
তবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্টে কপালে ভাঁজ পড়েছে ভারতীয় অর্থনীতিবিদদের। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছে ভারতীয় টাকা, এমনটাই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্টে ৷ ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বের একাধিক আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দেশের আর্থিক পরিস্থিতির কারণে ভারতীয় টাকা চ্যালেঞ্জের সামনে পড়বে।
রিপোর্টে এও উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতীয় টাকা যে বিষয়গুলির জন্য চাপে থাকবে তার মধ্যে রয়েছে, ধীর গতির বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ, দুর্বল উৎপাদন-রফতানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সংকীর্ণ নীতিগত বৈষম্য। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের রিপোর্টে অনুমান করা হয়েছে, পরবর্তী ১২ মাসে মার্কিন ডলার প্রতি ৮৫.৫ টাকার স্তরে পৌঁছবে ।
যদিও ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, আকর্ষণীয় প্রকৃত ফলন, আন্তর্জাতিক বন্ড সূচকে এর অন্তর্ভুক্তির কারণে আর্থিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য বজায় থাকবে। দ্রব্যমূল্য নিম্নমুখী হওয়া এবং ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (আরবিআই) তরফে গৃহিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সিদ্ধান্তের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ টাকার অবমূল্যায়ন প্রবণতার গতিকে ধীর করে দিতে সক্ষম হতে পারে । কিন্তু, তাতে টাকার অবমূল্যায়ন বন্ধ হতে কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে এই রিপোর্টে।
তবে অন্যদিক থেকে দেখলে ওই রিপোর্টটি ভারতীয় ইক্যুইটির জন্য বেশ কয়েকটি ইতিবাচক চালিকা শক্তির উল্লেখ করেছে। এটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের জিডিপি বৃদ্ধি এবং কর্পোরেট আয় বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলির রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (এসআইপি) এবং বিদেশি বিনিয়োগের পুনঃপ্রবাহের মাধ্যমে স্থির অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ প্রবাহ উচ্চতর সামষ্টিগত অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়গুলিতে অনুপ্রাণিত, প্রত্যাশিত ভাবে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার হ্রাস করা এবং তুলনামূলকভাবে কম বিদেশি বিনিয়োগ ভারতীয় শেয়ারবাজারের জন্য ভালো ফল দেবে বলে আশা করা হচ্ছে ৷
একইসঙ্গে এই রিপোর্টে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি পুনরুদ্ধারের পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে ৷ উচ্চতর সরকারি মূলধন ব্যয়, গ্রামীণ অঞ্চলে চাহিদা পুনরুদ্ধার, শহুরে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি এবং বৃহত্তর নীতি সহায়তার মতো কারণগুলির ফলে ভারতের অর্থনীতিতে উন্নতি হবে । রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রীষ্ম ও শীতকালীন ফসলের ভাল বপন এবং সরবরাহ সংক্রান্ত উদ্বেগগুলির জন্য সম্ভাব্য সরকারি পদক্ষেপ ও খাদ্যদ্রব্যের দাম কমার কারণে মূল্যবৃদ্ধির হার কম হওয়ার প্রত্যাশা করা হয়েছে । পাশাপাশি, অতীতের নীতি আঁটসাঁট করার ফলে মূল্যবৃদ্ধিজনিত প্রভাব মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে মূখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে ।
অন্যদিকে আগামী বছর আগামী বছর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হারও কিছুটা বাড়বে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩.০১ শতাংশ হলেও ২০২৫ সালে তা ৩.০২ শতাংশে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে দ্য মাস্টারকার্ড ইকোনমিকস ইনস্টিটিউট (এমইআই)। সেই সঙ্গে কমতে পারে মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার। এতে ভোক্তাদের ক্রয় সক্ষমতা বাড়বে, স্বস্তি আসবে তাঁদের জীবনে। বৃহত্তর বৈশ্বিক অর্থনীতিও চলবে এই একই ধারায়।