মার্লোন ব্র্যান্ডো মানেই সিনেপ্রেমীদের কাছে বিশেষ কিছু। যে নাম সামনে এলেই চোখের সামনে ফুটে ওঠে কালজয়ী ডন ভিটো কর্লিওনির চরিত্র। যা এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল সিনেমাজগতে। এই চরিত্র শুধু অভিনয় শিল্পকেই বদলে দেয়নি, নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছিল ‘নিখুঁত’ শব্দটিকে। বিখ্যাত অভিনেতা মার্টিন শিন বলেছিলেন, ‘ব্র্যান্ডো এককথায় সিনেমার ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা। আমার মনে হয় এতটুকু বললে কম হয়ে যাবে। তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রজন্মের কাছে মোজার্ট বা বেটোফেনের মতো।’ জীবনীকার প্যাট্রিসিয়া বসওয়ার্থের মতে, ‘মার্লোন ছিলেন একজন সাক্ষাৎ দানব; কিন্তু একজন বন্দনীয় দানব।’ সত্যিই তো, সিনেমার রুপোলি পর্দায় আমরা মার্লোন ব্র্যান্ডোর বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছি। স্ট্যানলি কোয়ালস্কি, ট্যারি ম্যালয়, ভিটো কর্লিওনি, কর্নেল ওয়াল্টার কার্টজ এই রকম নানা চরিত্রে ফুটে উঠেছেন তিনি। তবে ক্যামেরার লেন্সটুকু সরিয়ে ফেললে আমাদের সামনে উপস্থিত হন ভিন্ন এক ব্র্যান্ডো। এই ব্র্যান্ডোর শৈশব ছিল দুঃসহ, যার প্রতিটি পদক্ষেপে জড়িয়ে আছে সমালোচনা ও বিতর্ক। এই ব্র্যান্ডোকে পত্রিকার পাতায় পাওয়া যেত মদ্যপ, বিশৃঙ্খল এবং ‘ব্যাড বয়’ হিসেবে। কিন্তু এসব ঘটনা তার কীর্তিকে কোথাও কোনওদিন মলিন করে দিতে পারেনি।
ঘাত-প্রতিঘাত আর আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত হযে মার্লোন পা রাখলেন ১৭ বছর বয়সে। এরপরই তাঁকে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেও মার্লোনের চরিত্র এতোটুকুও বদলায়নি।সবার সঙ্গে মারামারি করে দিন কাটাতো। আর এই সব ঘটনা সহ্য করতে নারাজ মিলিটারি অ্যাকাডেমি। ফলে আইন অনুযায়ী তাকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে মার্লোনের। অ্যাকাডেমির পাঠদানে তিনি অমনোযোগী থাকলেও একটি ক্লাসে তাকে বেশ নিয়মিত দেখা যেত। সেটি ছিল থিয়েটার ক্লাস। পারিবারিক ক্রোধের সবটুকু যেন তিনি তাঁর এই অভিনয়শিল্পে প্রয়োগ করতেন। এদিকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি পাড়ি জমান নিউইয়র্কে। সেখানে ভর্তি হন স্টেলা এডলারের অভিনয় স্টুডিওতে। স্কুল এবং একাডেমি জীবনের ভাঙা ভাঙা অভিনয় প্রতিভাকে দক্ষ প্রশিক্ষকের সান্নিধ্যে জোড়া লাগাতে থাকেন তিনি। এদিকে তৎকালীন অভিনয় স্কুলগুলোতে পুরনো ধাঁচের অভিনয় তালিম দেওয়া হতো। সেখানে মার্লোন শুরু করলেন হাল আমলের বিখ্যাত ‘মেথড অ্যাক্টিং’ পদ্ধতি। মার্লোন ব্র্যান্ডো যেন কোনও চরিত্র অভিনয় করতেন না, বরং তিনি নিজেই হয়ে উঠতেন সেই চরিত্র।অভিনয়কালীন আবেগ, বাচন-ভঙ্গি যেন সবকিছুই স্বাভাবিক।
অভিনয় তালিম শেষে তাঁর অভিনয়ে হাতেখড়ি ১৯৪৪ সালে। ‘আই রিমেম্বার মামা’ নামে ব্রডওয়ে থিয়েটারের মাধ্যমে শুরু হয় তার জীবনের নতুন এক অধ্যায়। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসায় ভাসেন তরুণ অভিনেতা ব্র্যান্ডো। একের পর এক ব্রডওয়েতে অভিনয়ের পর তিনি ১৯৪৭ সালে তার সেরা ব্রডওয়ে অভিনয় উপহার দেন ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’-এ। যেখানে স্ট্যানলি কোয়ালস্কি চরিত্র এক ভবিষ্যৎ তারকার জন্ম দেয় অভিনয় জগতে।
এরপর আরও এক মোড় ব্র্যান্ডোর জীবনে। ব্রডওয়েতে সাড়া ফেলে দেওয়া ব্র্যান্ডোর পথ চলা শুরু হলিউডে। এক যুদ্ধফেরত যুবকের চরিত্রে তাঁকে দেখা গেল ‘দ্য ম্যান’-এ। ১৯৫০ সালে হলিউডে মুক্তি পাওয়া এই ছবির মুক্তির পর ব্র্যান্ডোর প্রশংসা না করে পারেননি সিনে সমালোচকরা। পরের বছরই তাঁরই ব্রডওয়ে অভিনীত নাটক ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’-এর সিনেমা সংস্করণে অভিনয় করেন। সেখানেও তিনি ছিলেন প্রধান চরিত্র স্ট্যানলি কোয়ালস্কির চরিত্রে। যা তাঁর সিনেমা জীবনে এক মাইলস্টোন। কারণ, এরপরই সব পরিচালক মার্লোনকে চান নিজের সিনেমায়। এরপর তিনি উপহার দেন একের পর এক হিট সিনেমা। এই তালিকায় রয়েছে ‘ভিভা জাপাতা! (১৯৫২)’, ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট (১৯৫৪)’, ‘গাইজ এণ্ড ডলস (১৯৫৫)’, ‘দ্য ইয়াং লায়ন্স (১৯৫৮)’। ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’-এ অভিনয়ের জন্য পান ‘সেরা অভিনেতা’ বিভাগে অস্কারও। এরপরই ব্যয়বহুল সিনেমা ‘মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি’তে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। তবে তার বিশৃঙ্খল জীবনযাপন তাঁর ক্যারিয়ারের দফারফা করে দেয়। ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা বক্স অফিসে ব্যাপক ভরাডুবির মুখে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে পরবর্তী এক দশক পর্যন্ত।
এদিকে তখন হলিউডে কালজয়ী পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা হন্যে হয়ে খুঁজছেন গডফাদার সিনেমায় ভিটো কর্লিওনি চরিত্রে অভিনয় করার জন্য একজন সঠিক অভিনেতার। কিন্তু কাউকেই মনে ধরছিল না তার। তাই উপায় না দেখে তিনি মুখ ফেরান গত দশকের প্রতিভাবান অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডোর দিকে। প্রথমে প্রযোজকরা রাজি না হলেও শেষপর্যন্ত নানা শর্তে রাজি হন। এরপর কপোলার কথামতো সব শর্ত মেনে ‘গডফাদার’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হন। শর্ত অনুযায়ী তাঁকে দিতে হয় স্ক্রিন টেস্টও। এরপর মারিও পুজোর উপন্যাসের ভিটো কর্লিওনি চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছিল মার্লোন ব্রান্ডোর অভিনয় দক্ষতায়। যা বক্স অফিস সফলতা ছাড়াও সমালোচকদের দৃষ্টিতে এখনও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে সমাদৃত। তবে সবচেয়ে চমক অপেক্ষা করেছিল গডফাদারে অসাধারণ অভিনয়ে অস্কারের মনোনয়ন ঘিরে। দ্বিতীয়বার তিনি ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য মনোনয়ন পেলেও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। বিজেতা হিসেবে তার নাম ঘোষণার পর দেখা যায় তার বদলে মঞ্চে উপস্থিত হন এক রেড ইন্ডিয়ান নারী। তিনি জানান, স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের সাথে সরকারের বৈরী আচরণের কারণে মার্লোন ব্র্যান্ডো অস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরপরও ‘লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস’, ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ’-সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় তাঁকে দেখা যায়। অনেকেই বলেন ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ’-এ তাঁর অভিনয় অভিনয় শৈলীর শীর্ষ ছুঁয়েছিল। এরপর নানা অসুস্থতার কারণে ২০০৪ সালের ১ জুলাই আশি বছর বয়সে লস এঞ্জেলসে প্রয়াত হন মার্লেন ব্র্যান্ডো। তবে তাঁর ক্যারিশ্মা যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল তা তাঁর মৃত্যুর পরও রয়ে গেছে অলঙ্ঘ্য হিসেবেই।