শীর্ষস্থানীয় গ্লোবাল সাইবার সিকিউরিটি সংস্থা ট্রেন্ড মাইক্রো ভারতে তাদের ওয়ার্ল্ড ট্যুরের কলকাতা পর্ব সফলভাবে শেষ করল। দেশের চার শহরব্যাপী হওয়া এই সফরের কলকাতা পর্বে, ৪৫টিরও বেশি সংস্থা থেকে ৯০–র বেশি প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ বছরের থিম ‘Proactive Security Begins Here’-এ প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিরক্ষা থেকে দূরদর্শী, এআই–চালিত নিরাপত্তা কৌশলের দিকে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।
শারদা টিক্কু, ভারত ও SAARC অঞ্চলের কান্ট্রি ম্যানেজার, ট্রেন্ড মাইক্রো তাঁর কী–নোট ভাষণে তুলে ধরেন, কীভাবে সাইবার আক্রমণকারীরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে আরও দ্রুতগতিতে হামলা চালাচ্ছে। যেখানে আগে যেটা করতে কয়েক সপ্তাহ লাগত, এখন তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘটছে। তবে তিনি এটাও জানান যে, প্রতিরক্ষামূলক আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই–ও সমান দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে, যার ফলে এখন রিয়েল–টাইম শনাক্তকরণ, স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া এবং আগাম ঝুঁকি মোকাবিলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি Agentic AI-কে একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি বলে আখ্যায়িত করে বলেন, যেখানে একাধিক বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এজেন্ট একসঙ্গে কাজ করে আগাম ও সমন্বিত সাইবার সুরক্ষা প্রদান করে।এই পুরো ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে ট্রেন্ড মাইক্রো–র AI-চালিত প্ল্যাটফর্ম Trend Vision One™, যা ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সাইবার সিকিউরিটি LLM Trend Cybertron-এর সঙ্গে একীভূত। এর মাধ্যমে পাওয়া যায় পূর্বাভাসমূলক বিশ্লেষণ, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং স্বয়ংক্রিয় সমাধানের সুবিধা। AI যেখানে নিরাপত্তা পরিচালনা কেন্দ্র (SOC)-এর কাজকেই রূপান্তর করছে, সেখানে শারদা টিক্কু জোর দিয়ে বলেন—মানব পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান এখনও অত্যন্ত জরুরি।
‘Proactive Security: The Next Big Shift’ শীর্ষক একটি প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ডঃ আর. এন. পাত্র (জেনারেল ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেলিকম / বিভাগীয় প্রধান, কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড), রাকেশ ওঝা (ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, SAIL), এবং দিনেশ কুমার শ্রীমালি (CISO ও DPO, টাটা স্টিল)। আলোচনায় তাঁরা তুলে ধরেন, কীভাবে প্রোঅ্যাকটিভ সিকিউরিটিকে প্রতিষ্ঠানের কৌশলের অংশ করে তোলা যায়। এদিন বক্তব্য রাখতে গিয়ে ডঃ পাত্র জোর দেন বহুস্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর, যার সূচনা হয় শারীরিক নিরাপত্তা ও ব্যবহারকারীর সচেতনতা থেকে। বিশেষ করে IT ও OT-এর একীভূত পরিকাঠামোয়, তিনি প্রাথমিক পরিকল্পনা করার সময় থেকেই কমপ্লায়েন্স অন্তর্ভুক্ত করার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এই প্রসঙ্গে শ্রীমালি জানান, জটিল সিস্টেমের ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকি (ভালনারেবিলিটি) আগে মোকাবিলা করা হবে, তা নির্ধারণ হওয়া উচিত ঝুঁকির প্রভাব এবং সংস্থানগত সীমাবদ্ধতার ভিত্তিতে। তিনি আরও বলেন, প্রোঅ্যাকটিভ ডিফেন্স বাস্তবায়নে উন্নত থ্রেট ইন্টেলিজেন্স এবং দক্ষ মানবসম্পদে বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
অন্যদিকে, সেল এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওঝা তুলে ধরেন সাইবার ঝুঁকি মূল্যায়নের গুরুত্ব, যেখানে Cyber Risk Index (CRI)-এর মতো কাঠামো ব্যবহার করে নিরাপত্তা বিনিয়োগের সঙ্গে ব্যবসায়িক অগ্রাধিকারের সুস্পষ্ট সামঞ্জস্য স্থাপন সম্ভব।
সমস্ত প্যানেলিস্ট একমত হন যে, সাইবার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা একটি ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। তাঁরা জোর দেন অটোমেশন এবং রিয়েল–টাইম ভিজিবিলিটির গুরুত্বের ওপর। AI সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তাঁরা বলেন, এটি একদিকে যেমন নিরাপত্তার সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, অন্যদিকে এটি নিজেই একটি সম্ভাব্য ঝুঁকিও। তাই দায়িত্বশীলভাবে AI ব্যবহারের জন্য ISO 42001-এর মতো গভর্নেন্স কাঠামো প্রয়োগ করা জরুরি। তাঁরা এটাও তুলে ধরেন যে, IT ও OT-এর মধ্যে সাইবার সিকিউরিটির একীকরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারণ একটি ইউনিফায়েড ভিউ–এর মাধ্যমে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও উন্নত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।
আলোচনার উপসংহারে সবাই একমত হন যে, প্রোঅ্যাকটিভ সিকিউরিটি কেবল প্রযুক্তিনির্ভর কোনো বিষয় নয়—এটি একটি সাংগঠনিক মানসিকতার পরিবর্তন, যা সচেতনতা, সংহতি এবং প্রতিটি স্তরে ধারাবাহিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে গড়ে তুলতে হয়।
পূর্ব ভারতের বাজার ধীরে ধীরে প্রযুক্তি ও সাইবার সুরক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি পরিণত কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ট্রেন্ড মাইক্রো–র এই অঞ্চলে ১৫ বছরের উপস্থিতির প্রেক্ষিতে এখন স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন সংস্থা ক্রমশ ইউনিফায়েড প্ল্যাটফর্ম–ভিত্তিক সমাধান এবং Security Operations Center as a Service (SOCaaS)-এর দিকে ঝুঁকছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা প্রমাণ করে যে, সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিত সাইবার সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাপড়া আরও গভীর হয়েছে এবং তারা দ্রুত পরিবর্তনশীল সাইবার হুমকির পরিবেশে নিজেদের প্রতিরক্ষা আরও শক্তিশালী করতে কৌশলগত পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ট্রেন্ড মাইক্রো–র সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ম্যালওয়্যার শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বে তৃতীয় এবং এশিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী মোট সাইবার অপরাধের ৪.৭৪% এসেছে ভারত থেকে, যেখানে প্রায় ১.৯৩ কোটি ম্যালওয়্যার ঝুঁকি শনাক্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে ব্যাংকিং, ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস এবং সরকারি ক্ষেত্র—যা দেখাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো এখনও সাইবার অপরাধীদের প্রধান টার্গেট।
এই ক্রমবর্ধমান এবং জটিল সাইবার হুমকির প্রেক্ষাপটে, ট্রেন্ড মাইক্রো এ বছর ভারতের চারটি শহরে নিয়ে আসছে তাদের Trend World Tour। এর লক্ষ্য—সংস্থাগুলিকে উন্নত সাইবার সিকিউরিটি কৌশল সম্পর্কে সচেতন করা এবং সম্মিলিত প্রতিরক্ষার উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করা। এই ট্যুরের পরবর্তী পর্ব অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আগামী ১৮ই জুলাই, ২০২৫ তারিখে বেঙ্গালুরুতে।