কলকাতা প্রেস ক্লাবের গ্রাম-কৃষ্টি উৎসবে মিলছে বঙ্গ সংস্কৃতির শিকড়ের সন্ধান

 

শুভাশিস বিশ্বাস

 

কলকাতায় কংক্রিট আর অ্যাসফল্টে আটকে গেছে আমাদের জীবন। এই ব্যস্ত জীবন থেকে একটু মুক্তির স্বাদ খুঁজি প্রত্যেকেই। মন হারিয়ে যেতে চায় সবুজের মাঝে একটু খোলা আকাশের নিচে।  কিন্তু সে সবুজের খোঁজ পেতে হলে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে হবে বেশ কিছুটা দূরে। তবেই আকাশটাকে চোখে রেখে মন হারানোর জায়গা খুঁজে পেতে পারি। কিন্তু সমস্যা তো সেখানেই। ছুটি বা সময় মেলা তো সবার পক্ষে সম্ভব নয় সব সময়। তাই বলে গ্রামের সেই শান্ত পরিবেশ কি কোথাও মিলবে না! হ্যাঁ, মিলবে। একেবারে খোদ শহরের কেন্দ্রস্থলেই। ধর্মতলায় কলকাতা প্রেস ক্লাব ময়দানে। যেখানে ২৪ ডিসেমম্বর থেকে শুরু হয়েছে গ্রাম-কৃষ্টি উৎসব। আর এই উৎসবের হাত ধরেই কলকাতা প্রেস ক্লাব ময়দানে হাজির এক টুকরো গ্রাম। এই গ্রাম-কৃষ্টি উৎসবের বেশ কয়েকটা অভিমুখ রয়েছে তা ক্লাব প্রাঙ্গনে পা না রাখলে বোঝা দায়। একদিকে গান বাজনা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন প্রতিদিন আমাদের বঙ্গ সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করছে ঠিক তেমনই এই ‘গ্রাম কৃষ্টি’ উৎসবের হাত ধরে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গন এক মেলার রূপ নিয়েছে। এই মেলাতে মূলত মিলবে প্রত্যন্ত গ্রামের নানা শিল্পীর হাতের কাজ। যে সব শিল্পী আমাদের সংস্কৃতির শিকড়কে ধরে রাখলেও কখনওই প্রচারের আলোয় আসার সুযোগ পান না। এই সব হস্তশিল্পীকে প্রচারের আলোয় এনে তাঁদের জীবনে নতুন এক গতি আনতে চাইছেন প্রেস ক্লাবের কর্মকর্তারা। কারণ, কলকাতার বাজার তাঁদের সামনে খুলে গেলে এই সব প্রান্তিক শিল্পীদের লাভ তো বটেই, একইসঙ্গে লাভ কলকাতাবাসীরও। কারণ, কলকাতায় যাঁদের জীবন কর্মসূত্রে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে তাঁদের পক্ষে সবসময় জানা সম্ভব নয় এই সব প্রান্তিক শিল্পীদের শিল্পকর্ম সম্পর্কেও। সেই কারণেই সোনাঝুরি গাছের কাঠ মেহগনির থেকেও বেশি দামি। অর্থাৎ, এই মেলার মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে পরিচয় করানো সম্ভব গ্রামের ঐতিহ্যমণ্ডিত বিভিন্ন শিল্প কর্মের সঙ্গেও।

এই গ্রাম কৃষ্টি উৎসব উপলক্ষ্যে যে মেলা বসেছে সেখানে রয়েছে নানা ধরনের খাদ্যের সমাহারও। যা পয়সা খরচ করলেও কলকাতার কোনও বড় দোকান বা মলে মেলা ভার। রয়েছে খাঁটি মধু, জয়নগরের মোয়া থেকে পাঁপড়ের মতো আরও কত কিছু! এমনকী নানা ধরনের চালেরও সন্ধান মিলছে এবারের এই গ্রাম কৃষ্টি উৎসবে। খাদ্যের পাশাপাশি মিলবে নানা ধরনের শিল্পকর্মও। সঙ্গে মিলছে মহিলাদের জন্য নানা ধরনের কপারের ওপর গোল্ড প্লেটেড গয়নাও।

যাঁরা স্টল দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে ছোট্ট একটা আলাপচারিতা করতেই সামনে এল কিছু তথ্য। তাঁদের বক্তব্য, কলকাতা আর তার উপকণ্ঠে এই বড়দিন উপলক্ষ্যে নানা ধরনের মেলা বসছে। আর এই সব মেলায় জায়গা পাওয়া বেশ কঠিন। সেদিক থেকে তাঁরা কৃতজ্ঞ প্রেস ক্লাবের কাছে। তবে বিক্রি-পাট্টা নিয়ে কোথাও একটা চিন্তার আভাস মিলল তাঁদের গলায়। অনেকেরই ধারনা, প্রেস ক্লাবের একটা আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। ফলে এই গ্রাম-কৃষ্টি মেলা একটা সাধারণ মেলার মতো নয়। প্রেস ক্লাবের চত্বরে পা রাখতে ভয় পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। সমস্যাটা সেখানেই।

এদিকে এই মেলাকে উৎসবের রূপ দিচ্ছে প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ২৪ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা এই গ্রাম-কৃষ্টি উৎসবের মঞ্চে থাকছে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যেখানে অংশ নিচ্ছেন প্রত্যন্ত গ্রামের লোকশিল্পীরাই।

কলকাতা প্রেস ক্লাবের তরফ থেকে নেওয়া এই উদ্যোগ সম্পর্কে ক্লাব সম্পাদক কিংশুক প্রামাণিক জানান, ‘ ক্লাবের সদস্য ও তাঁদের পরিবারকে গ্রাম কৃষ্টি মেলা ক্লাবের উপহার। প্রত্যন্ত গ্রামের হস্তশিল্পীদের শিল্প নৈপুণ্যে জমজমাট হয়ে ওঠে এই মেলা। এবছর এই মেলা সাত বছরে পড়ল। এই দীর্ঘ সময়ে ক্লাব সদস্যদের পরিবার ও তাঁদের পরিচিত সহ বহু পথ চলতি মানুষের কাছে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই উৎসব। এই গ্রাম-কৃষ্টি উৎসবের মাধ্যমে বঙ্গ সংস্কৃতির আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটুক এটাই লক্ষ্য।’ ক্লাব সভাপতি স্নেহাশিস সুর জানান, ‘অনেক মেলার মধ্যে প্রেস ক্লাবের এই মেলা বাংলার সাংবাদিকদের কাছে একটা অন্য স্থান করে নিয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির পীঠস্থান গ্রাম।আর সেই গ্রামের নানান সংস্কৃতি, উৎপাদিত পণ্য সহ এই কটা দিন রাজ্যের গ্রাম বাংলার সামগ্রিক সংস্কৃতিই যেন হাজির হয় ক্লাব প্রাঙ্গণে।’ মেলার অন্যতম আয়োজক প্রসূন ভৌমিক জানান, ‘গ্রাম বাংলার অর্থনীতি অনেকটাই জড়িয়ে এই সব মেলার উপর। রাজ্যের উন্নয়নে ও শিল্পী, উদ্যোগীদের উন্নয়নে এই ধরনের ছোট মেলা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।’ ফলে বঙ্গ সংস্কৃতির শিকড়কে খুঁজতে গ্রাম্য আর শহুরে সংস্কৃতি মিলে মিশে একাকার কলকাতা প্রেস ক্লাবের গ্রাম-কৃষ্টি উৎসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − eight =