একটি ভালভাবে বেঁচে থাকা জীবন সম্পর্কে কথা বলার মতো একটি জীবন। সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারানোর পরেও জীবনকে নতুন করে তৈরি করা য়েতে পারে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন বিধাননগর থানার অন্তর্গত মহিষবাথানে একটি অভিজাত আবাসনের বাসিন্দা মহম্মদ আসিফ ইকবাল।
এবার টাটা মুম্বই ম্যারাথনে অংশ নিতে চলেছেন কলকাতার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আসিফ ইকবাল। এর জন্য চলছে তাঁর প্রস্তুতিও।এই প্রসঙ্গে বলে রাখা শ্রেয়, টাটা মুম্বাই ম্যারাথন ২০২৩ এবং ২০২৪-এ হাফ ম্যারাথমেও অংশ নেন। এবছর তিনি তাঁর দুই বন্ধু দৌড়বিদের সঙ্গে প্রথম পূর্ণ ম্যারাথন দৌড়াবেন। লক্ষ্য হল দৌড় জুড়ে ৮:১৫ গতি বজায় রেখে ৫ঘন্টা ৫০ মিনিটের মধ্যে ম্যারাথন শেষ করা। এই ম্যারাথন দৌড় প্রসঙ্গে আসিফ এও জানান, ‘আমার জন্য, ম্যারাথন কেবল একটি দৌড় নয়। এটি নিজেকে এবং বিশ্বকে দেখানোর একটি সুযোগ।আমাদের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে আমরা মনে করি তা থাকে আমাদের মনেই।’ আসন্ন টাটা মুম্বাই ম্যারাথন একটি বিশেষ সংস্করণ হতে চলেছে, যেখানে এশিয়ার বৃহত্তম ম্যারাথন ২০টি গৌরবময় বছর পূর্ণ করবে।
এই ম্যারাথনে প্রশিক্ষণের একটি প্রধান দিক হল আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার।তিনি একটি ঘড়ি ব্যবহার করেন যা তার গতি, গড় সময় এবং দূরত্বের উপর রিয়েল-টাইম অডিও আপডেট সরবরাহ করে। ইতিমধ্যে, সঙ্গীত তার বাডি রানার কোমর সংযুক্ত ওয়্যারলেস স্পিকার থেকে ক্রমাগত বাজানো হয়, যা তাকে অন্য রানারদের সঠিক অবস্থান জানায়। এই ম্যারাথনের জন্য অত্যন্ত কঠোর অনুশীনও করছেন ইকবাল। তাঁর কোচের নির্ধারিত কঠোর সময়সূচি অনুসরণ করে সপ্তাহে তিনবার দৌড়ানও। প্রতি রবিবার তার বন্ধু দৌড়বিদ সুমিত দাসের সাথে দীর্ঘ পথও দৌড়ান। সম্প্রতি আসিফ তার প্রথম পূর্ণ ম্যারাথন সম্পন্ন করেন, যা নিঃসন্দেহে এক বিশাল প্রাপ্তি।
এই প্রসঙ্গে আসিফ ইকবাল এক বার্তায় তিনি জানান, ‘এই লক্ষ্যে আমি বহু বছর ব্যয় করেছি। এটা কেবল প্রতিযোগিতার বিষয় নয় – এখানে আসার জন্য প্রয়োজন দায়বদ্ধতা ও ধারাবাহিকতার।’ এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, গত বছর, তিনি মুম্বইয়ে অর্ধ ম্যারাথন শেষ করেন ২ ঘন্টা ৪৮ মিনিটে। এবং কলকাতায় টিএসডাব্লু ২৫কে শেষ করেন ৩ ঘন্টা ১৫ মিনিটে। এক বার্তায় তিনি জানান, ‘আমি উপলব্ধি করি, এটা শুধু শক্তির ব্যাপার নয়। এর জন্য দরকার কঠিন মানসিকতার। পাশাপাশি আসিফের সংযোজন, ‘যদি আমি ফোকাস করি এবং প্রস্তুত থাকি, তাহলে আমি জানি আমি আমার লক্ষ্য অর্জন করতে পারব।’
আসিফ সম্পর্কে বলতে গেলে আসে অনেক কথাই। বছর আটচল্লিশের ইকবাল রেটিনাল ডিজেনারেশন নামক একটি জেনেটিক ব্যাধির কারণে জন্মের পর থেকে আংশিক দৃষ্টিশক্তি হারান। এরপর ১৬ বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারান। তবে এরপরও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন শহরে তার উচ্চ বিদ্যালয় এবং আংশিক কলেজ শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। এরপর ইকবাল ১৯৯৫সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং পরবর্তীতে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাণিজ্য স্নাতক হন এবং সিম্বিওসিস ইনস্টিটিউট, পুনে থেকে মানবসম্পদ বিষয়ে এমবিএ করেন।
প্রায় ছয় বছর আগে তার উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে। এরপরই সারাজীবন ওষুধ খাওয়ার থেকে ইকবাল তাঁর জীবনকে অন্য ভাবে পরিচালন করার সিদ্ধান্ত নেন। এই প্রসঙ্গে তিনি এও জানান, ‘আমি ভেবেছিলাম আমার স্বাস্থ্য জাতি গঠনে আমার অবদানের পথে বাধা হওয়া উচিত নয়। শুধু সুস্থ থাকার জন্য কিছু করার চিন্তা করতে হবে। আমার ওজন বেশি ছিল। আমি বন্ধুদের সাহায্যে খেলার মাঠ এবং পার্ক পরিদর্শন শুরু করি। সেখানেই ম্যারাথনে অংশ নেওয়ার ধারণাটি আমার মাথায় আসে। এরপরই আমি নিজের আত্মবিশ্বাস তৈরি করার জন্য দৌড়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। এরপর দৌড়ানো একটা রুটিন হয়ে যায়।’ এরপর ১০০ মিটার থেকে শুরু করে, তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় ধীরে ধীরে ৩০০ এবং পরে তাঁর দৌড়ের যাত্রাপথ আরও কয়েক কিলোমিটার বাড়িয়েছিলেন। ধীরে ধীরে, তিনি নিজেই ন্যাভিগেশন শেখেন। এই প্রসঙ্গে তিনি এও জানান, ‘আমি আমার পারফরম্যান্স বাড়ানোর জন্য নিজের সাথে যেন প্রতিযোগিতা করতাম’। এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, ২০২১ সাল থেকে, ইকবাল ১২টি বিভিন্ন রেসে যেখানে প্রতিটিতে তিনি ১০ কিলোমিটার অতিক্রম করেছেন। প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক মাস্টার ব্লাস্টার শচীন তেন্ডুলকার তার সাহসী উদ্যোগের জন্য স্বীকৃতিও দেন। তবে তার সবচেয়ে বড় মুহূর্তটি ২০২২-এর ১৮ ডিসেম্বর। যেদিন তিনি শুধুমাত্র ভয়েস গাইডেন্সের মাধ্যমে কলকাতায় টিএসকে-২৫ কিমি (১৫.৫৩মাইল) ম্যারাথন দৌড় শেষ করেন।